দামুড়হুদা উপজেলার ভেদাগাড়ি ও দলকার বিলের জনমানুষের মোহনা হিসেবে বিবেচিত হয়ে মর্যাদাপ্রাপ্ত হয়েছে ভগিরথপুর বাজারের উপরে বিশালাকৃতির বটগাছটি। তিন রাস্তার সমাহার হিসেবে ব্যবহৃত নতিপোতা ইউনিয়নের প্রাণকেন্দ্র (যেখানে মাধ্যমিক বিদ্যালয়, প্রাথমিক বিদ্যালয়, স্বাস্থ্য কেন্দ্র, ডাকঘর, বাজার-ঘাট বিদ্যমান)। শুধুমাত্র শতবছর বয়সী বটগাছের কল্যাণে গড়ে উঠেছে এ নন্দিত জনপদটি। কথিত আছে হিন্দু জনগোষ্ঠীর বিচ্ছিন্ন একটি মৎস্যজীবী সম্প্রদায় দলকা-ভেদাগাড়ির আদলে এ চরের মানুষরা লড়াই করে জনবসতি শুরু করেছিলো, বিধায় স্থানটি রথের মর্যাদাপ্রাপ্ত হয়। আর এ সম্মানের বা মর্যাদাপ্রাপ্তিতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করেছিলো যে উপাদানটি তা হলো ভগিরথপুর বাজারের উপর অবস্থিত দলকা-লক্ষীপুরের নতিপোতামুখী উপ-অঞ্চল ভগিরথপুর অঞ্চল।
এ বটগাছের নিচে দু’দ- শান্তি প্রত্যাশায় মানুষ আসতো সকাল-বিকেল। গল্প করতো, আড্ডা দিতো, সময় কাটাতো আর সৃজনশীল সকল কর্মকা-ের উৎসমূল হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে সময়ে সময়ে। ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১০ কি.মি. পূর্বদিক কালীগঞ্জ আড়পাড়া-খাজুরা সড়কের ত্রিমোহনী সংলগ্ন মল্লিকপুরে প্রায় ১১ একর জমির উপরে অবস্থিত বটগাছটি শুধু বাংলাদেশের মধ্যে নয় এশিয়ার মধ্যে সর্ববৃহৎ বটগাছ হিসেবে ইতিহাসে স্থান পেয়েছে। এটি ঝিনাইদহের একটি গর্ব যেমন, তেমনি ভগিরথপুরের বটবৃক্ষটিও চুয়াডাঙ্গা জেলার একটি গর্বের ধন (যদিও সম্প্রতি গাছটি বয়সের ভারে এবং সম্প্রসারণ হওয়ার ভূমির অভাবে প্রধান সড়কের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত হওয়ার কারণে ঝুঁকিপূর্ণ ছিলো বিধায় অনেকটা জনরোষে বিলুপ্ত)।
বাংলাদেশের একটি মর্যাদাশীল জেলার নাম চুয়াডাঙ্গা এশিয়ার মধ্যে হয়তো সেরা জেলা হতে পারেনি; তবে বাংলাদেশের মধ্যে আদর্শ মানুষের স্তরে স্বল্পভাষী, মিষ্টিভাষী, বাড়তি কথা না বলা, মিথ্যা কথা পরিহার করা, পরিচ্ছন্ন ও রুচিশীল পোশাক পরিধান করা, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি না দেয়া, সৃজনশীল কাজের সাথে থাকা, অহেতুক তোষামোদ পরিহার করা, দেশীয় পণ্যের প্রতি প্রেম, ভালো প্রতিষ্ঠানে জ্ঞানচর্চা করা, বইপাঠের মাধ্যমে মনোজগতের সমৃদ্ধি বাড়ানোর কাজে নিজেকে বটবৃক্ষের ঐতিহ্যের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থেকেছেন যিনি তিনি মকবুলার রহমান, তিনি কিংবদন্তিতুল্য মুন্সীগঞ্জের বটবৃক্ষ মকবুলার রহমান।
শান্তি নিকেতন থেকে কথা বলা শিল্পের উপর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে শ্রুতিমধুর ভাষায় কথা বলায় কথ্য শিল্পকে দান করেছেন একটি বিশেষ মর্যাদা, দিয়েছেন বিশেষ সম্মান। তার কারণে দেশের এ কোনায় ও কোনায় চুয়াডাঙ্গার ভাষার মর্যাদা শতভাগ সম্মানবৃদ্ধি না ঘটতেও তার বয়সের কাছাকাছি প্রায় পৌছে দিতে যেতে পেরেছেন।
খাওয়া, ঘুমানো, অহেতুক আড্ডা দেয়া বা পয়সা কামানোর পেছনে শ্রম দিয়ে সময় কাটানো যখন একজন মানুষের সময় অতিবাহিত করার প্রধানতম অভ্যাস তখন তিনি এ মাত্রার সাথে যুক্ত করেছেন বইপড়া নেশার সংযোগ। বইপড়া থেরাপি ব্যবহারে যে মানুষের বাহ্যিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি হয় এবং ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের জ্যোতির বিচ্ছুরণ ঘটে গবেষণাগারে বছরের পর বছর সাধনা করে তিনি তা প্রমাণ করেছেন সাহসী সাধক হিসেবে, যা হয়তো দ্বিতীয়টি নেই বাংলায়; বাঙালির অভিধানে। তেমন একজন সাধন বীরপুরুষের নাম মকবুলার রহমান, যার বাড়ি চুয়াডাঙ্গা জেলার মুন্সিগঞ্জ রেলস্টেশন সংলগ্ন চাতালে।
সংবাদপত্র প্রকাশ করে অত্যন্ত বিপরীত ¯্রােতে গ্রাম-এ ছড়িয়েছেন সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার গতিধারা। তিনি যতটা না সাংবাদিক ছিলেন তার চেয়ে বেশি ছিলেন সাংবাদিকদের রাখাল। তাই তার ছাতার তলে গ্রাম-এর শীতল ছায়ায় ঠাঁই পেয়েছে ঝাঁক ঝাঁক সাংবাদিক। সেকারণে চুয়াডাঙ্গার চরে চরে ছুটে বেড়ানো সাংবাদিক স্বতীর্থরা মকবুলার রহমানকে খুঁজে বের করে বসিয়েছেন সাংবাদিকদের বাতিঘর প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির বরেণ্য চেয়ারে।
তিনি কথা সাহিত্যিক ছিলেন। বঙ্কিম, শরৎ, মীর মোশারফ হোসেন, মানিক বন্দোপাধ্যায়, হুমায়ূনের মতো ডজন ডজন বই প্রকাশ করেননি সত্য, তবে সূধিমহলের জলশায় মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে যে কথা শুনিয়ে গিয়েছেন তার পূর্বে সম্ভাবত এতো মধুর করে মানুষকে মৃগ্ধ করতে পারেননি আর কেউ। তাই তাকে কথাশিল্পী বলা নিশ্চয় অন্যায় হবে না।
মওলানা ভাসানীর মতো লুঙ্গির প্রতি তার বিশেষ প্রেম ও মমত্ব ছিলো অপরিসীম বাঙালিত্বের একটি পোশাক বৈচিত্রতায়। তিনি অনায়াসে সংকোচহীনভাবে লুঙ্গি পরেই বিচরণ করতে পারতেন। সাধারণ থেকে অসাধারণ পরিম-লের সর্বত্র। এতে তার না ছিলো কুন্ঠা, না ছিলো সঙ্কা। বরং এক ধরনের প্রচ্ছন্ন গর্ববোধ কাজ করতো তার মন ও মননে।
স্বল্পভাষী মানুষরাও যে নির্বাচনী ময়দানে ঝুঁড়ি ঝুঁড়ি ভোট কোড়াতে পারেন মকবুলার রহমানকে কাছ থেকে যাঁরা না দেখেছেন তাঁদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে। প্রথম উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যানপ্রার্থী হিসেবে তিনি প্রতিপক্ষের প্রার্থীকে নিজে কম কথা বলা অস্ত্রে ঘায়েল করেই প্রমাণ করেছেন শুধু বেশি কথা বলার অস্ত্র দিয়ে নয় কম কথা বলার মধ্যদিয়েও প্রতিপক্ষের তীরকে রুখে দেয়া সম্ভব। নির্বাচনী ময়দানে এক সমাবেশে একজন সচেতন ভোটার তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন- “আপনি কম কথা বলেন কেন?” উত্তরে তিনি বলেছিলেনÑ “আমার বাবার শিক্ষা, বেশি কথা বললে দু’একটা মিথ্যা কথা বের হয়ে যেতে পারে। তাই, কম কথা বলি”।
একটি বিশাল বটগাছের ছায়ায় যেমন দিনে বিভিন্ন ধরনের মানুষ এসে বসে, বিশ্রাম গ্রহণ করে, নিঃস্বার্থ প্রাকৃতিক সেবা গ্রহণ করে, বৃক্ষের মানব প্রেমের সাথে পরিচিত হয় তেমনি একজন মকবুলার রহমানের সাথে শিক্ষা দরদি মন নিয়ে মিশলে একজন হৃদয়বান প্রকৃত মানুষকে খুঁজে পাওয়া যাবে, একজন জ্ঞান পিপাসু জ্ঞানীর দেখা পাওয়া যাবে, একজন গ্রন্থপ্রেমিক মহৎ মানুষের সন্ধান পাওয়া যাবে, একজন সৎ ও সহজলভ্য জনপ্রতিনিধি দেখা পাওয়া যাবে। দেখার চোখ নিয়ে দেখলে প্রায় শত বছরের বটবৃক্ষের যে বিশাল জীবন মানবকল্যাণে ত্যাগ করা হয়েছে তার সোনালী ফুলে ভরা নান্দনিকতাপূর্ণ জীবন বোধের অস্তিত্বের সন্ধান মিলবে একজন মকবুলার রহমানকে আধুনিক উদার মনের আলোয় চাতক পাখির দৃষ্টিতে দেখলে।
পূর্ববর্তী পোস্ট
করোনা ভাইরাসে চুয়াডাঙ্গায় মৃত্যু বেড়ে ৪৭ জন : দেশে ৮ হাজার ৭২
এছাড়া, আরও পড়ুনঃ