ইমরানের পরামর্শে পার্লামেন্ট ভেঙে দিলেন প্রেসিডেন্ট : অনাস্থা নাটক শেষে ভোটে পাকিস্তান
রাজনৈতিক উত্থান-পতন পরিস্থিতির সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই : সেনাবাহিনী
মাথাভাঙ্গা মনিটর: আগেই বলেছিলেন, হাতে অন্য অস্ত্র আছে। রোববার কাজেও সেটা করে দেখালেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। ‘২২ গজের’ মতোই শেষ বলে ম্যাচ ঘুরিয়ে দিলেন ‘ক্যাপ্টেন’। আপাতত বাঁচিয়ে নিলেন তার প্রধানমন্ত্রীর ‘কুরসি’। এর পরিবর্তে দ্রুত নির্বাচন প্রক্রিয়ার পথেই হাঁটলো ইমরান খানের সরকার। পাকিস্তানের পার্লামেন্টের ডেপুটি চরম অগণতান্ত্রিকভাবে অনাস্থা প্রস্তাব বাতিল করে দেওয়ার পর ইমরান খানের আহŸানে পার্লামেন্ট ভেঙে দেন দেশটির প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি। সংবিধান অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়ায় এখন তত্ত¡াবধায়ক সরকার গঠন করা হবে, তারাই ৯০ দিনের মধ্যে পরবর্তী নির্বাচন করবে। কয়েকদিন ধরেই দেশটির রাজনৈতিক নাটক জমে উঠেছিলো। গতকাল রোববার সকাল থেকে সেই নাটকের ‘ক্লাইমেক্স’ চরমে ওঠে। আস্থা ভোটকে কেন্দ্র করে দেশটির একাধিক এলাকা অশান্ত হয়ে উঠেছিলো। সহিংসতা রুখতে রাজধানী ইসলামাবাদে জারি করা হয়েছিলো ১৪৪ ধারা। শোনা গিয়েছিলো, গ্রেপ্তার হতে পারেন ইমরান। এর মাঝেই বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ পাকিস্তানের পর্লামেন্ট- ‘ন্যাশনাল অ্যাসেম্বির (জাতীয় পরিষদ) অধিবেশন শুরু হয়। যেখানে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনার কথা ছিলো।
অধিবেশনের শুরুতেই নাটকের নতুন অধ্যায়। দেখা যায়, বিরোধীরা ইমরানের আগে পার্লামেন্টের স্পিকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা আনে। এরপরই ইমরানের বিরুদ্ধেও অনাস্থা প্রস্তাব আনা হয়। সেই সময় পার্লামেন্টে ইমরানের দলের মাত্র ২২ জন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। পরাজয় প্রায় নিশ্চিত। হাজির ছিলেন না ইমরানও। ঠিক যখন পাকিস্তানের নির্বাচিত সরকারের পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখনই শেষ মুহূর্তে ‘ম্যাচ বাঁচিয়ে’ নিলেন ১৯৯২ সালে ক্রিকেটে বিশ্বকাপজয়ী পাকিস্তান দলের ‘ক্যাপ্টেন’ ইমরান।
পার্লামেন্টে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আনা অনাস্থা প্রস্তাবই খারিজ করে দেন ডেপুটি স্পিকার কাসিম শাহ সুরি। তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আনা অনাস্থা প্রস্তাব আসলে সংবিধান-বিরোধী। এই প্রস্তাবের পেছনে বিদেশি চক্রান্ত আছে। এরপরই আগামী ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত মুলতবি করে দেন পার্লামেন্টের অধিবেশন। এরপরই জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন ইমরান খান। সেখানে তিনি জানান, রাষ্ট্রপতির কাছে পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। একই সঙ্গে দ্রুত নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরুর প্রস্তাব দেয়ার কথাও জানিয়ে দেন। জাতির উদ্দেশে ইমরান বলেন, ‘নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিন। দেশের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা কোনো দুর্নীতিবাজ শক্তি নির্ধারণ করবে না। যখন পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়া হবে, তখন পরবর্তী নির্বাচন ও তত্ত¡াবধায়ক সরকারের প্রক্রিয়া শুরু হবে।’ তিনি বলেন, ‘আমি উদ্বিগ্ন, অনেক লোকের কাছ থেকে বার্তা পেয়েছি। জাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হচ্ছে। আমি বলতে চাই, চিন্তা করবেন না, পাকিস্তানে যা হচ্ছে তা আল্লাহ দেখছেন।’ কিছুক্ষণের মধ্যেই তার সুপারিশ মেনে নেন প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি। ফলে এখন দ্রুত নির্বাচনে যেতে হচ্ছে পাকিস্তানকে; আর সেটা ৯০ দিনের মধ্যে।
এদিকে, পাকিস্তানে রোববার কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক উত্থান-পতন পরিস্থিতির সঙ্গে সেনাবাহিনীর কোনো সম্পর্ক নেই বলে জানিয়েছে দেশটির সেনাবাহিনী। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আন্তঃজনসংযোগ দপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল বাবর ইফতিখার বলেন, আজ (রোববার) যা ঘটেছে, তা নিয়ে সেনাবাহিনীর কিছুই করার নেই। ২০১৮ সালে সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় ক্ষমতায় আসেন ইমরান খান। স¤প্রতি বিভিন্ন ইস্যুতে সেনাবাহিনীর সঙ্গে তার দূরত্ব বাড়তে শুরু করে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ইমরান খান মস্কো সফর করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি স্পষ্টভাবেই রাশিয়ার পক্ষে রয়েছেন বলে জানিয়ে দিয়েছেন। অথচ শনিবার সামরিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া এক অনুষ্ঠানে বলেন, রাশিয়ার বৈধ নিরাপত্তা উদ্বেগ থাকলেও এই সংঘাত নিয়ে পাকিস্তান মারাত্মকভাবে দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত। ছোট একটি দেশের বিরুদ্ধে রাশিয়ার অভিযান ক্ষমা করা যায় না। ইমরান খান ও প্রভাবশালী সেনাবাহিনীর মধ্যকার সম্পর্ক যে তিক্ততার পর্যায়ে চলে গেছে, শনিবার জেনারেল বাজওয়ার মন্তব্যেই তা স্পষ্ট হয়ে যায়।
পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) নেতা বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি বলেছেন, তার দল নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। একই সঙ্গে তাদের আইনি দল একটি পিটিশন নিয়ে কাজ করছে। তারা সুপ্রিম কোর্টে যাবে। বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি বলেন, ‘আমরা সাধারণ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। কিন্তু আমরা নিয়ম ও সংবিধান লক্সঘন হতে দিতে পারি না। তারা (সরকার) পাকিস্তানে অস্থিতিশীলতা চায়। কিন্তু আরও একবার আমরা তাদের পরাজিত করবো।’ তিনি বলেন, অনাস্থা প্রস্তাবের ওপর ভোট বাতিলের কোনো অধিকার ডেপুটি স্পিকারের নেই।
অন্যদিকে, পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়ার আগে পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের গর্ভনর চৌধুরি সারওয়ারকে তার পদ থেকে সরিয়ে দেন ইমরান। ইমরান খানের বিরুদ্ধে পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটের মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে তাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয় পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) সরকার। পাঞ্জাব প্রদেশের গভর্নরের পদ থেকে চৌধুরি সারওয়ারকে বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত রোববার সকালে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় তথ্যমন্ত্রী ফাওয়াদ চৌধুরী একটি টুইট বার্তায় ঘোষণা করেন। সে সময় ফাওয়াদ বলেন, পাঞ্জাবের নতুন গভর্নরের নাম পরে ঘোষণা করা হবে। তার ভাষায়, ‘ততদিন পর্যন্ত, সংবিধান অনুযায়ী ডেপুটি স্পিকার ভারপ্রাপ্ত গর্ভনর হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।’
কয়েকটি স‚ত্রের বরাত দিয়ে ‘এক্সপ্রেস ট্রিবিউন’ বলেছে, পাঞ্জাবের আইনসভার স্পিকার পারভেজ এলাহির অভিযোগের ভিত্তিতেই গর্ভনরকে অপসারণ করা হয়েছে। পাঞ্জাবের মূখ্যমন্ত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রে গর্ভনর সারওয়ার আলিম খান গ্রæপকে সমর্থন দিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছিলেন এলাহি। ম‚লত মুখ্যমন্ত্রী পদে এলাহির বিরুদ্ধে পিএমএল-এন’র হামজা শেহবাজকে সমর্থন করছে আলিম খান গ্রæপ।
উল্লেখ্য, পাকিস্তানে পুরো মেয়াদ প‚র্ণ করতে না পারা প্রধানমন্ত্রীর তালিকা দীর্ঘ। তত্ত¡াবধায়ক প্রধানমন্ত্রীও হয়েছেন অনেকে। সেই ইতিহাসেরই যেন পুর্নর্নির্মাণ হলো রোববার। পূর্বসূরিদের মতোই আরও একটা মিল তৈরি করলেন ইমরান।
পাকিস্তান রাজনীতিতে ভারত বিরোধিতার যে ধারা, তাও অক্ষুণœ রেখেছেন ইমরান খান। ক্ষমতায় আসার পর প্রথম টেলিভিশন বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, ‘ভারত যদি আমাদের দিকে এক ধাপ এগিয়ে আসে, আমরা তাদের দিকে দুই ধাপ এগোব।’ কিন্তু তার আমলে ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক মোটেও ভালো যায়নি। আর টিকে থাকার মরিয়া চেষ্টার মধ্যেই গত বৃহস্পতিবার তার বিরুদ্ধে চক্রান্ত এবং বিরোধীরা দেশের সার্বভৌমত্ব বিক্রির চক্রান্ত করছে অভিযোগ তুলতে গিয়ে কৌশলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দিকে ইশারা করেন ইমরান। এক ভারতীয় সাংবাদিকের বইয়ের উদাহরণ তুলে ইমরান বলেন, ‘ওই বইয়ে লেখা আছে- ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে আমাদের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ নেপালে গোপন বৈঠক করেছেন।’ ঘটনাচক্রে, ইমরানের বিরুদ্ধে পাক পার্লামেন্টে অনাস্থা প্রস্তাব এনেছিলো নওয়াজের দল পাকিস্তান মুসলিম লিগ (নওয়াজ)। প্রধানমন্ত্রিত্বের দাবিদার হিসেবে উঠে আসছিলো নওয়াজের ভাই শাহবাজের নামও। কিন্তু এখন সব হিসাব হবে ভোটে।
রাজনৈতিক জীবন একেবারে ছোটও নয় ইমরানের। ১৯৯২ সালে ক্রিকেট বিশ্বকাপ জয়ের পর ১৯৯৬ সালে রাজনীতির ময়দানে আসেন। দুর্নীতি-বিরোধী স্লোগান তুলে ১৯৯৬ সালের এপ্রিলে প্রতিষ্ঠা করেন তার দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)। পরের বছর ১৯৯৭ সালে তিনি নির্বাচনে দুটি কেন্দ্র মিয়াওয়ালি এবং লাহোর থেকে দাঁড়ালেও হেরে যান। তবে এতে থামেননি। ২০০২ সালে মিয়াওয়ালি থেকে জয়ী হন। প্রথমে সেনাপ্রধান পারভেজ মোশাররফকে সমর্থন দিলেও ২০০৭ সালে ৮৫ জন পার্লামেন্ট সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে পদত্যাগ করেন ইমরান। সে বারের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট হয়ে মোশাররফ পাকিস্তানে জরুরি অবস্থা জারি করেন। গৃহবন্দি করা হয় ইমরানকে। কিছুদিন হাজতবাসও করতে হয়। তবে রাজনৈতিক লড়াই চলতেই থাকে। ২০১৩ সালে পাকিস্তানের দশম নির্বাচনে তার দল দ্বিতীয় বৃহত্তম হয় আর ২০১৮ সালের ২৫ জুলাই পাকিস্তানের একাদশ জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে। ১৮ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন।
ক্রিকেট মাঠে বরাবর নায়োকিচত ছিলেন ইমরান। অনেকে ভেবেছিলেন, রাজনীতিতেও তিনি নায়কের মতো আসবেন, দেখবেন, জয় করবেন। পাকিস্তানের রাজনীতির বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ২২ গজের সফল অধিনায়ক নিজেও বুঝতে পারেননি রাজনীতির মঞ্চে খেলাটা অন্যরকম। সেটা বুঝতে বুঝতেই প্রায় দেড় দশক কাটিয়ে ফেলেন ইমরান। ষড়যন্ত্র, সন্ত্রাস, মৌলবাদসহ নানা রোগে ভরা পাক রাজনীতিতে টিকে থাকতে হলে যে মেপে পা ফেলা উচিত, তা সেটাই নাকি মানতে চাননি ইমরান। সারাক্ষণই তিনি দেশে দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনের কথা বলেছেন। গণতান্ত্রিক সরকারে সেনাবাহিনী, আইএসআই-এর প্রভাব নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। অনেকের সমর্থন পেলেও সেটা মোটের থেকে অনেক কম। ফলে রাজনীতিতে বারবার হোঁচট খেতে হয়েছে স্পোর্টসম্যান খানকে। একটা সময় বুঝতে শুরু করেন নিজের ত্রæটি। নওয়াজকে সরিয়ে সেনাবাহিনী ও আইএসআই-এর আরও কাছে চলে আসেন। প্রধানমন্ত্রীর কুরসিতে বসার স্বপ্নও সফল হয়ে যায়। কিন্তু পুরোপুরি রক্ষা পাননি। জোটসঙ্গী মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট পাকিস্তানের (এমকিউএম-পি) পাশাপাশি ইমরান সরকারের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয় বেলুচিস্তান আওয়াম পার্টিও। এরপরও অনেক চেষ্টা চালিয়েছেন। খেলা ঘুরিয়ে দিতে উদ্যোগী হয়েছেন অনবরত। এতে ক্ষমতা ধরে রাখতে সফল হলেও এটা মানতেই হবে যে, খেলাটা ঠিক খেলার মতো হলো না। খেলা জিতলেন খেলা ভন্ডুল করেই।