কিয়েভ ইরপিনসহ তিন শহরে মুহুর্মুহু হামলা : তৃতীয় দফা বৈঠক আজ
প্রাণপণ ছুটছে মানুষ : পুতিন বললেন পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা যুদ্ধ ঘোষণার শামিল
মাথাভাঙ্গা মনিটর: ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের একাদশতম দিন ছিল রোববার। এদিন রাজধানী কিয়েভ, ইরপিন ও ভিন্নিতসিয়া শহরে মুহুর্মুহু ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়েছে। কিয়েভ দখলে নিতে কৌশলগত কারণে আগে ইরপিন দখল করতে চাইছে রুশ সেনারা। কিয়েভের দক্ষিণে একটি জলবিদ্যুৎ বাঁধের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুপক্ষের মধ্যে তুমুল লড়াই চলছে। বেসামরিক লোকদের সরে যাওয়ার সুযোগ দিতে এদিন মারিওপোল শহরে আবারও ৯ ঘণ্টার যুদ্ধবিরতি দেয়া হয়। আগেরদিন এ শহরটিসহ ভলনোভাখায় ৫ ঘণ্টার যুদ্ধবিরতি ছিল। তবে সেদিন মারিওপোলে যুদ্ধবিরতিতেও বোমা হামলা অব্যাহত ছিল বলে অভিযোগ করে ইউক্রেন। শনিবার রাতে জনগণের উদ্দেশে দেয়া ভাষণে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এদিকে সংঘাতের অবসানের লক্ষ্যে রাশিয়া ও ইউক্রেনের প্রতিনিধি দল আজ তৃতীয় দফায় বৈঠকে বসতে যাচ্ছে। এবারের বৈঠকও বেলারুশে অনুষ্ঠিত হবে। ভিসা ও মাস্টারকার্ড কর্তৃপক্ষ রাশিয়ায় তাদের কার্যক্রম স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন বলেছেন, ‘ইউক্রেন আক্রমণের পর পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়ার ওপর যেসব নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে- তা যুদ্ধ ঘোষণার শামিল।
ইউক্রেন সেনাবাহিনী জানায়, রোববার রুশ বাহিনী রাজধানী কিয়েভের দক্ষিণে অবস্থিত গুরুত্বপূর্ণ কানিভ জলবিদ্যুৎ বাঁধ দখলের চেষ্টা চালায়। সেখানে তুমুল প্রতিরোধ গড়েছে ইউক্রেন সেনারা। দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর জেনারেল স্টাফের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ওই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি রাজধানী কিয়েভ থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে দিনিপার নদীতে অবস্থিত। এর আগে রুশ সেনারা ইউক্রেনের জাপোরিজ্জিয়া পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র দখল করে নেয়। এরপর তারা আরেক পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ইউঝনুকরাইস্ক দখলে মরিয়া হয়ে উঠেছে। কিয়েভের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলেও তীব্র লড়াই চলছে। সেখানে ঐতিহাসিক হস্তোমেল বিমানঘাঁটি দখলের চেষ্টা করছে রুশ বাহিনী। এছাড়া কিয়েভের উপকণ্ঠে অবস্থিত ছোট শহর ইরপিনে একের পর এক বোমাবর্ষণ করে যাচ্ছে মস্কো। ভিন্নিতসিয়া শহরের একটি বিমানবন্দরে অন্তত আটটি মিসাইল হামলা চালিয়েছে রুশ সেনারা। এছাড়া শহরগুলোর আবাসিক এলাকায় বোমা ফেলা হচ্ছে। যুক্তরাজ্যের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থাও বলছে, ইউক্রেনের জনবহুল এলাকা লক্ষ্য করে হামলা চালাচ্ছে রুশ সেনারা। রাশিয়া ১৯৯৯ সালে চেচনিয়া এবং ২০১৬ সালে সিরিয়ায় একই কৌশল অবলম্বন করে বলে অভিযোগ ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন বলেছেন, ‘ইউক্রেন আক্রমণের পর পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়ার ওপর যেসব নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে- তা যুদ্ধ ঘোষণার শামিল। কিন্তু ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে- এখনো সেই সময় আসেনি।’ পুতিন সতর্ক করে আরও বলেন, ‘ইউক্রেনের ওপর নো-ফ্লাই জোন সৃষ্টির যে কোনো প্রচেষ্টাকে সশস্ত্র সংঘাতে অংশগ্রহণ হিসেবে দেখা হবে।’ গত শনিবার মস্কোর কাছে একটি অ্যারোফ্লট প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে একদল মহিলা ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্টের সঙ্গে কথা বলার সময় পুতিন এসব মন্তব্য করেন। তিনি উল্লেখ করেন, তিনি ইউক্রেনে রুশভাষী সম্প্রদায়কে ন্যায্যতার ভিত্তিতে রক্ষা করতে চাইছেন। ‘পশ্চিমা প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের অভিযোগ- রাশিয়ান সামরিক অভিযান প্রত্যাশার চেয়ে কম’ এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের সেনাবাহিনী সব কাজ সম্পন্ন করবে। রাশিয়ার সশস্ত্র বাহিনী ইউক্রেনের সামরিক অবকাঠামো ধ্বংসের কাজ প্রায় শেষ করে এনেছে। বিশেষ এ সামরিক অভিযান পরিকল্পনা অনুযায়ীই চলছে।’
এদিকে ইউক্রেনের একটি সামরিক বিমানঘাঁটিতে হামলার দাবি করেছে রাশিয়া। রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইগর কোনাশেনকভ দাবি করেন, রোববার সকালে দূরপাল্লার উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন নির্ভুল অস্ত্র দিয়ে চালানো এ হামলায় ইউক্রেনের স্টারোকোস্টিয়ানটিনিভ সামরিক বিমানঘাঁটি নিষ্ক্রিয় করে দেয়া হয়েছে।
ইউক্রেনের মারিউপোল শহরে নতুন করে আবারও যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয়েছে। শহরের স্থানীয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, রোববার স্থানীয় সময় সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত যুদ্ধবিরতি কার্যকর ছিল। বেসামরিক বাসিন্দারা এই সময়ে শহর ছেড়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। এর আগে শনিবার মারিওপোল ও ভলনোভাখা শহরে ৫ ঘণ্টার যুদ্ধবিরতি ঘোষণা হলেও রুশ সেনারা মারিওপোলে বোমা হামলা অব্যাহত রেখেছিল বলে দাবি করে ইউক্রেন।
১১ হাজারের বেশি রুশ সেনাকে হত্যার দাবি করেছে ইউক্রেন। রোববার ইউক্রেন সেনাবাহিনীর জেনারেল স্টাফের পক্ষ থেকে এই দাবি করা হয়েছে। এছাড়া রাশিয়ার ২ হাজার অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম ধ্বংস করেছে তারা। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ২৮৫টি ট্যাংক, ৪৪টি যুদ্ধবিমান ও ৪৮টি হেলিকপ্টার। তবে ইউক্রেন নিজেদের সেনাবাহিনী ও বেসামরিক হতাহতের কথা জানায়নি।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অর্থ লেনদেন মাধ্যম ভিসা ও মাস্টারকার্ড কর্তৃপক্ষ রাশিয়ায় তাদের কার্যক্রম স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছে। ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযান শুরুর পর থেকে বিভিন্ন মার্কিন ব্যবসায়িক ও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান মস্কোতে কার্যক্রম স্থগিত করছে। সবশেষ এ তালিকায় যুক্ত হলো ভিসা ও মাস্টারকার্ড। এক বিবৃতিতে মাস্টারকার্ড কর্তৃপক্ষ বলেছে, চলমান সংঘাতের নজিরবিহীন প্রকৃতি ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে আমরা রাশিয়ায় আমাদের নেটওয়ার্ক সেবা স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আলাদা বিবৃতিতে ভিসা কর্তৃপক্ষ বলেছে, আগামী দিনগুলোতে রাশিয়ায় সব ভিসা লেনদেন বন্ধ করতে দেশটিতে নিয়োজিত সহকর্মী ও সহযোগীদের সঙ্গে কাজ করবে তারা। সিদ্ধান্তটি অবিলম্বে কার্যকর হবে বলেও জানিয়েছে তারা।
রাশিয়া ও ইউক্রেনের প্রতিনিধি দল আজ তৃতীয় দফায় বৈঠকে বসতে যাচ্ছে। ইউক্রেনে রক্তাক্ত সংঘর্ষের অবসানের লক্ষ্যে এর আগে বেলারুশে উভয়পক্ষ আরও দুদফা বৈঠক করেছে। ইউক্রেনের আলোচক ডেভিড আরাখামিয়া বিষয়টি নিশ্চিত করেন। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদমির জেলেনস্কির দলের পার্লামেন্টারি নেতা এবং প্রতিনিধি দলের সদস্য আরাখামিয়া তার ফেসবুক পেজে বলেন, সোমবার (আজ) তৃতীয় দফার বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এর আগে বেলারুশের গোমেল অঞ্চলে ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে দুই দেশের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন বেলারুশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভ¬াদিমির মাকেই। তবে সেই বৈঠকটি কোনো চুক্তি ছাড়াই শেষ হয়। পরে ৩ মার্চ আবারও বৈঠক হয়। এতে উভয়পক্ষ বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপদে সরিয়ে নিতে ‘মানবিক করিডোর’ নির্মাণে সম্মত হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে স্থানীয় সময় রোববার ফোনে কথা বলেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা ও ইউক্রেনে অর্থনৈতিক সহযোগিতা নিয়ে দুজনের মধ্যে আলোচনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলেনস্কি। এক টুইটে জেলেনস্কি বলেন, ‘চলমান আলোচনার অংশ হিসাবে আমি বাইডেনের সঙ্গে আরেকবার আলোচনা করেছি। ইউক্রেনের নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক ইস্যু, রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা নিয়ে বাইডেনের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে।’ ওই আলোচনার বিষয়ে হোয়াইট হাউজ বলেছে, ইউক্রেনে হামলার জন্য রাশিয়ার ওপর চাপ বাড়াতে পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে বাইডেন তার প্রশাসন ও মিত্রদের সঙ্গে কথা বলেছেন।
অপ্রত্যাশিত নিরাপত্তার কথা উল্লেখ করে নিজ দেশের নাগরিকদের অবিলম্বে রাশিয়া ছাড়ার পরামর্শ দিয়েছে কানাডা। শনিবার দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিবৃতিতে জানিয়েছে, রাশিয়ার নিরাপত্তা পরিস্থিতি অপ্রত্যাশিত এবং বিনা নোটিশেই অবনতি হতে পারে। মন্ত্রণালয় এক ভ্রমণ নির্দেশিকায় আরও জানিয়েছে, রাশিয়া থেকে ফ্লাইট একদমই সীমান্ত হয়ে উঠেছে। দেশটিতে দূতাবাসের ক্ষমতা আরও সীমিত হতে পারে।