সংসদীয় ৫৫ আসনের সীমানা পুনঃনির্ধারণ নিয়ে জটিলতা
ডিসেম্বরেই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করতে চায় নির্বাচন কমিশন
স্টাফ রিপোর্টার: আসছে ডিসেম্বরেই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করতে চায় নির্বাচন কমিশন। এ লক্ষ্যে নির্বাচনের প্রস্তুতিমূলক কাজ শুরু করেছে সাংবিধানিক সংস্থাটি। তবে সংসদীয় আসনের সীমানা পুনঃনির্ধারণ নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে। সীমানা পুনঃনির্ধারণ আইন সংশোধন ছাড়া এই কাজে হাত দিতে পারছে না নির্বাচন কমিশন। আইন সংশোধনে ইতোমধ্যে সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হলেও তা এখনো আলোর মুখ দেখেনি। এমন প্রেক্ষাপটে সীমানা পুনঃনির্ধারণের কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। ফলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আইন সংশোধন না হলে আগের বিতর্কিত সীমানা ধরেই নির্বাচন আয়োজনের কথা ভাবছে ইসি।
এদিকে নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, জাতীয় সংসদের ৫৫টি আসনের সীমানা নিয়ে জটিলতা রয়েছে। এসব আসনের সীমানা পুনঃনির্ধারণের জন্য নির্বাচন কমিশনের কাছে এখন পর্যন্ত ৩৬০টিরও বেশি আবেদন পড়েছে। ইসি’র কর্মকর্তারা জানান, সংসদীয় আসনের সীমানা পুনঃনির্ধারণে জনসাধারণের আবেদনকে প্রাধান্য দেবে ইসি। এক্ষেত্রে আইন সংশোধনের পরেই কার্যক্রম শুরু করা হবে। আইন সংশোধন না হওয়ায় এই কার্যক্রম ঝুলে আছে। তারা বলছে, সীমানা পুনর্বিন্যাস করতে ন্যূনতম ৬ মাস সময় লাগে। ডিসেম্বরে নির্বাচন আয়োজন করতে হলে দ্রুত আইন সংশোধন হওয়া প্রয়োজন।
ওদিকে সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণে কাজ ইসির কাছে না রেখে একটি স্বতন্ত্র কমিশনের অধীনে এই কাজ করার প্রস্তাব দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক গঠিত নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। সরকারের কাছে তারা প্রস্তাব করেছে, সংসদীয় এলাকার সীমানা নির্ধারণ একটি জটিল ও সময়ক্ষেপণকারী বিষয়, যেখানে বিশেষায়িত জ্ঞান ও দক্ষতা প্রয়োজন। নির্বাচন কমিশনের এ কাজের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা আছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। আর আগত নির্বাচনের প্রস্তুতির জন্য নির্বাচন কমিশনকে অনেক সময়-শ্রম দিতে হবে। তাই আমাদের আকাক্সক্ষা যে, সংসদীয় এলাকার সীমানা নির্ধারণের মতো কঠিন ও কষ্টসাধ্য কাজে সময় ব্যয় করার পরিবর্তে নির্বাচন কমিশন আসন্ন নির্বাচনের প্রস্তুতিতে সর্বশক্তি নিয়োগ করুক। এজন্য নির্বাচন কমিশনের পরিবর্তে একটি আলাদা সীমানা নির্ধারণ কমিশন গঠনের প্রস্তাব করেছে সংস্কার কমিশন। তবে এ বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে ঐকমত্য কমিশনকে চিঠি দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। সংস্থাটি বলেছে, এর প্রয়োজন নেই। সংস্কার কমিশনের সুপারিশে আসন সীমানা পুনঃনির্ধারণের যে ফর্মুলার কথা বলা হয়েছে, সেটি হলে শহরাঞ্চলে আসন বেড়ে যাবে।
এদিকে সংসদীয় আসনের সীমানা পুনঃনির্ধারণ নিয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, ৫৫টি আসনের সীমানা পুনঃনির্ধারণের জন্য এখন পর্যন্ত ৩৬০টি আবেদন পড়েছে। এসব আবেদন বিবেচনায় নিয়ে আমরা আইন সংশোধনের জন্য ইতিমধ্যে প্রস্তাব পাঠিয়েছি। সরকার এটি নিয়ে কাজ করছে। আমরা আশা করছি, দ্রুত আইন সংশোধন হয়ে যাবে। আপনারা ডিসেম্বরে নির্বাচন আয়োজন করতে চাচ্ছেন, সেক্ষেত্রে এখনই আইন সংশোধন না হলে তো সীমানা নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে যাবে-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সেক্ষেত্রে আগের সীমানা ধরেই নির্বাচন আয়োজন করা হতে পারে।
২০০৮ থেকে ২০২৩ সালের সীমানা নির্ধারণে যত বিতর্ক: বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যাপকভিত্তিক সীমানা পুনঃনির্ধারণের কাজ করা হয় ২০০৮ সালে। এ সময় জাতিসংঘের সহায়তায় একজন আন্তর্জাতিক সীমানা নির্ধারণ বিশেষজ্ঞকে নিয়োগ দিয়ে একটি গবেষণা করা হয়, যদিও ওই গবেষণার সকল পরামর্শ গ্রহণ করা হয়নি। ২০০৮ সালে মূলত প্রশাসনিক অখ-তা বিবেচনায় প্রাথমিকভাবে ১৩৩টি আসনে পরিবর্তন প্রস্তাব আনা হয়। এ প্রস্তাবের বিপক্ষে ৩২টি জেলার ৯৫টি আসনে ৩ হাজার ৬৯০টি লিখিত আপত্তি উত্থাপিত হয়। শুধু সাতক্ষীরা-৩ আসনেই ৯৮০টি আপত্তি জমা পড়ে। শুনানির পর ৮৪টি আসনে পরিবর্তন করে ৩০০ আসনের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হয়, যাতে বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকার ভোটার সংখ্যায় অসমতা পরিলক্ষিত হয়। ২০১৪ থেকে ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত শেষ তিনটি জাতীয় নির্বাচনে মোট ১৯৮টি আসনের সীমানা পুনর্বিন্যাস করা হলে নানান রাজনৈতিক বিতর্ক সৃষ্টি হয় এবং অনেকে আইনি ব্যবস্থা নেয়। ২০১৩ সালের সীমানা পুনঃনির্ধারণে বেশ কয়েকটি আসনে মন্ত্রী এবং এমপিদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের পছন্দ অনুযায়ী সীমানা নির্ধারণ করার অভিযোগ উঠে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে মূলত ২০১৩ সালের সীমানা অপরিবর্তিত রাখা হয়। ২০২৪ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ২০২৩ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি সংসদীয় আসনের সীমানা পুনঃনির্ধারণের খসড়া প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশনের ৩৮টি আসনের সীমানা পরিবর্তনের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ১৮৬টি আপত্তি জমা পড়ে। এই খসড়ায় সর্বশেষ জনশুমারি অনুযায়ী ৭৫টি আসনে জনসংখ্যার বড় ব্যবধান থাকলেও তা পরিবর্তনের জন্য বিবেচনায় নেয়া হয়নি। সর্বোচ্চ জনসংখ্যার আসনের সঙ্গে সর্বনি¤œ জনসংখ্যার আসনের মধ্যে সাত গুণের বেশি ব্যবধান হলেও (৮৮ শতাংশ) তা আমলে নেয়া হয়নি। এদিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিভিন্ন আসনের মধ্যে জনসংখ্যার বৃহৎ পার্থক্য রেখে সীমানা প্রশাসনিক ও ভৌগোলিক অখ-তার দোহাই দিয়ে মাত্র ১০টি আসনের সীমানা পুনর্বিন্যাস করা হয়।
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.