হাসপাতালে কোভিড-১৯ রোগী বেড়েই চলেছে : গ্রাম থেকে গ্রামে গণহারে ছড়াচ্ছে ভয়ানক ছোয়াচে ভাইরাস
স্টাফ রিপোর্টার: চুয়াডাঙ্গায় করোনা ভাইরাস সংক্রমিত হয়ে ও উপসর্গ নিয়ে আরও ১১ জন মারা গেছেন। গতকাল বুধবার চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালেই এদের মৃত্যু হয়। তবে সিভিল সার্জন বলেছেন, বুধবার ৩ জনের মৃত্যু নিয়ে জেলায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২৫ জন। এর মধ্যে চুয়াডাঙ্গায় ১০৯ জন, চুয়াডাঙ্গার বাইরে ১৬ জন। যদিও বাস্তবের সাথে এ হিসেবে অমিল রয়েছে। এছাড়াও নিজ নিজ বাড়িতে উপসর্গ নিয়ে ঠিক কতজনের মৃত্যু হয়েছে তা নিশ্চিত করে জানা সম্ভব হচ্ছে না। এদিকে গতকাল বুধবার চুয়াডাঙ্গার আরও ১৯১ জন করোনা ভাইরাস সংক্রমিত রোগী শনাক্ত হয়েছে। হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে রোগীর সংখ্যা বেড়ে ১৩২ জন হয়েছে। এছাড়াও বর্তমানে শনাক্তকৃত সক্রিয় রোগীদের মধ্যে ১৬২১ জন নিজ নিজ বাড়িতেই আইসোলেশনে রয়েছেন। এছাড়া ঘরে ঘরে সর্দি কাশি জ¦রে ভুগছেন অসংখ্য মানুষ।
চুয়াডাঙ্গা স্বাস্থ্য বিভাগ বুধবার নতুন ৩৯৪ জনের নমুনা নিয়েছে। এ নিয়ে জেলায় মোট ১৫৯২০ জনের নমুনা নেয়া হলো। এদিন পূর্বের প্রেরিত ৫১৫ জনের নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট স্বাস্থ্য বিভাগের হাতে আসে। এ নিয়ে মোট ১৫৪০২ জনের নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট পাওয়া গেছে। ৫১৫ জনের নমুনা পরীক্ষা করে শনাক্ত হয়েছে ১৯১ জন রোগী। এর মধ্যে সদর উপজেলার ৭৭ জন, আলমডাঙ্গা উপজেলার ৩৫ জন, দামুড়হগুদা উপজেলার ৩১ জন ও জীবননগর উপজেলার ৪৮ জন। দীর্ঘদিন ধরে দামুড়হুদা উপজেলায় কঠোর লকডাউনের সুফল মিলতে শুরু করেছে। করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ডেউয়ের ভয়াবহ আঘাত প্রথমে চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার ভারতী সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে আছড়ে পড়ে। দ্রুত সংক্রমণ বাড়ে। মৃতের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। প্রশাসন প্রথমে কার্পাসডাঙ্গাসহ পাশর্^বর্তী ১৯টি গ্রাম লকডাউন করে। পরবর্তিতে পুরো উপজেলায় লকডাউন করে প্রশাসন নানা উদ্যোগ নেয়। প্রচার প্রচারণার পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে প্রত্যন্ত অঞ্চলে অস্থায়ী ক্যাম্প করে নমুনা নেয়া হয়। এরপর থেকেই মূলত সংক্রমণের হার হ্রাস পেতে শুরু করে। বিষয়টি এখন অনেকটাই স্পষ্ট হয়েছে। প্রশাসনের তরফে বলা হয়েছে, চলমান কঠোর লকডাউন মেনে চললে জেলার অন্যান্য এলাকার সংক্রমণও নিয়ন্ত্রনে চলে আসবে বলে আশা করা যায়। নতুন ১৯১ জনকে নিয়ে জেলায় মোট করোনা ভাইরাস সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪২৬৬ জন। গতকাল সুস্থ হয়েছেন ২৬ জন। এ নিয়ে জেলায় মোট সুস্থ হলেন ২৩৮৫ জন।
চুয়াডাঙ্গা স্বাস্থ্য বিভাগসূত্রে জানা গেছে, জীবননগর উপজেলার একতারপুরের নজর আলীর ছেলে শাহাদত ম-ল সম্প্রতি সর্দি কাশি জ¦রে আক্রান্ত হন। নিজ বাড়িতেই চিকিৎসাধীন ছিলেন। শ^াসকষ্ট বাড়তে শুরু করলে গত পরশু মঙ্গলবার দুপুরে তাকে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে নেয়া হয়। নমুনা নেয়া হয়। তার নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট পাওয়ার আগেই গতকাল বুধবার বিকেল পৌনে ৫টার দিকে মারা যান ৭০ বছর বয়সী শাহাদত হোসেন। সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. ফাতেহ আকরাম বলেছেন, শাহাদত হোসেন করোনা উপসর্গে ভুগছিলেন। হলুদ জোনে ভর্তি করে চিকিৎসা দিয়েও তাকে সুস্থ করা সম্ভব হয়নি। চুয়াডাঙ্গা জেলা শহরের এতিমখানাপাড়ার বাসিন্দা দামুড়হুদা উপজেলার দলিয়ারপুর গ্রামের বাবলু বেগ বেশ কিছুদিন ধরে সর্দি কাশি জ¦রে ভুগছিলেন। শ^াস কষ্ট বাড়লে গতকাল বুধবা বেলা সাড়ে ১১টার দিকে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে নেয়া হয়। হলুদ জোনে ভর্তি করে নেয়া হয় নমুনা। চিকিৎসার এক পর্যায়ে বিকেল পৌনে ৫টার দিকে মারা যান ৫৮ বছর বয়সী বাবলু বেগ। তার মৃতদেহ গ্রামের বাড়ি দলিয়ারপুরে নেয়া হয়। গতরাতেই দাফন কাজ সম্পন্ন করা হয় বলে সংশ্লিষ্টসূত্রে জানা গেছে। বাবুল বেগম চুয়াডাঙ্গা ঝিনাইদহ বাসস্ট্যান্ডপাড়ার জামাতা। এতিমখানাপাড়ার বাসিন্দা ছিলেন। হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার বলেছেন, এ রোগীর শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ ছিলো। একেবারেই শেষ পর্যায়ে তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়। চুয়াডাঙ্গা জেলা সদরের মাদরাসাপাড়া (রায় পুকুরপাড়র) আতিয়ার রহমানের স্ত্রী জরিনা খাতুন সর্দি কাশি জ¦রে ভুগছিলেন। নিজ বাড়িতেই ছিলেন। অবস্থার অবনতি হলে গত ২৮ জুন নেয়া হয় সদর হাসপাতালে। নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করে তিনি কোভিড-১৯ পজিটিভ রোগী হিসেবে শনাক্ত হন। তাকে হাসপাতালের রেডজোনে নিয়ে চিকিৎসা দেয়া হয়। এরই এক পর্যায়ে গতকাল বুধবার বেলা সোয়া ১১টার দিকে ৩০ বছর বয়সী জরিনা খাতুন মারা যান। চুয়াডাঙ্গা জেলা সদরের হাসনহাটির মৃত কদম আলীর ছেলে শাহাদত হোসেন সর্দি কাশি জ¦রে ভুগছিলেন। শ^াস কষ্ট বেড়ে গেলে গতকাল বুধবার কাল পৌনে ৯টার দিকে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দুপুর দেড়ার দিকে মারা যান ৬০ বছর বয়সী শাহাদত হোসেন। র্যাপিড এন্টিটেস্ট পরীক্ষায় শাহাদত হোসেনের কোভিড-১৯ পজিটিভ হয়। দামুড়হুদা উপজেলার উজিরপুরের মৃত ইদ্রিস আলীর ছেলৈ নাসির উদ্দীন সর্দি কাশি জ¦রে ভুগছিলেন। নমুনা পরীক্ষায় তার কোভিড-১৯ পজিটিভ হয়। শ^াসকষ্ট বাড়ে। গতকাল বুধবার তার ছেলে মামুন ও ভাই সুফিয়ান গুরুতর অবস্থায় নাসির উদ্দীনকে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে নেন। মারা যান ৫০ বছর বয়সী নাসির উদ্দীন। শঙ্করচন্দ্র ডিঙ্গেদহের হোসেন আলীর স্ত্রী নাসিমা খাতুনকে গত ৫ জুলাই সন্ধ্যায় চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে নেয়া হয়। গতকাল বুধবার দুপুর ১২টার দিকে মারা যান নাসিমা খাতুন। হাসপাতালের আরএমও বলেছেন, নাসিমা খাতুনও করোনা উপসর্গে ভুগছিলেন। গতরাতে হাসাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার আরও জানিয়েছেন, আলমডাঙ্গার গাংনী নীমতলার ৫০ বছর বয়সী সিরাজুল ইসলাম, কুষ্টিয়া মীরপুরের সুতাইল গ্রামের ৪৫ বছর বয়সী জেসমিন, আলমডাঙ্গার কালীদাসপুর আসাননগরের ৩০ বছর বয়সী মালা খাতুনও করোনা মাহামারিতে মারা গেছেন। নিজ বাড়িতে থাকা অবস্থায় এরা মারা গেছেন বলে স্বাস্থ্যবিভাগসূত্রে জানা গেছে। আলমডাঙ্গা ব্যুরো জানিয়েছে, গতকাল আলমডাঙ্গায় করোনায় ২ ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। আলমডাঙ্গা উপজেলার বাঁশবাড়িয়া গ্রামের মৃত আহাদ আলীর ছেলে হাশেম আলী (৫৫) গত ১ সপ্তাহ পূর্বে সর্দিজ্বর ও শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হন। ওই অবস্থায় করোনা পরীক্ষায় তিনি পজিটিভ হলে তাকে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের করোনা ইউনিটে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হলে ৭ জুলাই দুপুরে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার সময় পথিমধ্যে বিকেল ৪টার দিকে তার মৃত্যু ঘটে। একই দিন আলমডাঙ্গার আসাননগর গ্রামের টিপন আলীর স্ত্রী রাশিদা খাতুন (৩৫) করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। সম্প্রতি তিনি সর্দিজ্বর ও শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হলে করোনা পরীক্ষায় পজিটিভ হন। তিনি বাড়িতেই চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। গতকাল দুপুরে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাছাড়া, করোনা উপসর্গ নিয়ে আলমডাঙ্গা পৌরসভার মসজিদপাড়ার পশু চিকিৎসক বকুল হোসীনের স্ত্রী ববি খাতুন (২৫) মারা গেছেন। সম্প্রতি তিনি সর্দিজ্বর ও শ^াস কষ্টে ভুগতে শুরু করেন। বাড়িতেই চিকিৎসা হচ্ছিলেন তিনি। তার ৮ বছর বয়সী একটা মেয়ে রয়েছে।
চুয়াডাঙ্গায় নতুন ১৯১ জন নতুন সংক্রমিত রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে সদর উপজেলার শুধুমাত্র মোবাইলফোন নম্বর দেয়া ৩১ জন। ভিমরুল্লার ৪ জন, জিনতলা মল্লিকপাড়ার ৩ জন, সাদেক আলী মল্লিকপাড়ার ৩ জন, শহরতলী দৌলাতদিয়াড়ের ২ জন, কোর্টপাড়ার ২ জন, কেদারগঞ্জের দুজন, নূরনগরে ২ জন, গুলশানপাড়ার ২ জন, সুমিরদিয়ার ২ জন, এতিমখানাপাড়র ২ জন, মাঝেরপাড়ার ২ জন, কুতুৃবপুরের ২ জন, এছাড়া একজন করে যেসব এলাকায় রোগী বুধবার শনাক্ত হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে কলেজপাড়া, পলাশপাড়া, ঝিনাইদহ বাসস্ট্যান্ডপাড়া, বাগানপাড়া, মাদরাসাপাড়া, বাজারপাড়া, জাফরপুর, বড়বাজার, শেখপাড়া, হাসপাতালপাড়া, গোরস্তানপাড়া, আলুকদিয়া, বাকুন্দ, দশমাইল, কুনিয়াচাঁদপুর, নবীননগর, বেগমপুর, হিজলগাড়ি, বকশিপুর, শঙ্করচন্দ্র, তিতুদহ, ঝাঝরি, কিরণগাছী, খাসপাড়া, নেহালপুর। আলমডাঙ্গা উপজেলার জামজামির ৩ জন, হাপানিয়ার দুজন, বৈদ্যনাথপুরের দুজন, টেঙরামারীর ২ জনসহ একজন করে যেসব এলাকায় বুধবার রোগী শনাক্ত হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে আলমডাঙ্গা শহর, পুরাতনবাজার, এমারজেন্সিপাড়া, আনোয়ারপুর, এরশাদপুর, আনন্দধাম, নওদা নগরপুর, প্রাগপুর, মধুপুর, ওসমানপুর, কামালপুর, উদয়পুর, রুইথনপুর, ভালাইপুর, ভাংবাড়িয়া, নীমতলা, রাধিকাগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, মোকামতলা ও নওদাপাড়া। দামুড়হুদা উপজেলার দর্শনা শহরেই ৮ জন, দামুড়হুদা সদরে দুজন, প্রতাবপুর দুজনসহ একজন করে যেসব এলাকায় বুধবার রোগী শনাক্ত হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে পরানপুর, জুড়ানপুর, উজিরপুর, ভগিরথপুর, পীরপুর কুল্লা, কুতুবপুর, জয়রামপুর, বিষ্ণপুর, মজারপুতা, কালিয়াবকরি, দেউলী ও চিৎলা। জীবননগর উপজেলার দেহাটির ৪জন, উথলীর ৪ জন, মিহাজপুরে ৪ জন, মনোহরপুরে ৩ জন, আন্দুলবাড়িয়ার দুজন, আশতলাপাড়ার ২ জন, মাধবপুরের দুজনসহ যেসব এলাকায় একজন করে রোগী শনাক্ত হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে যদুপুর, নারায়নপুর, হানিফপুর, কাশিপুর, সন্তোষপুর, মধুপুর, সুবলপুর, জীবননগর উপজেলা সদর, হাসপাতালপাড়া, পুরাতনপাড়া, মহানগরপাড়া, নতুনপাড়া, তারানিবাস, হরিহর নগর, পাথিলা, পদ্মপুকুর, তেলটুপি, খয়েরহুদা ও সুটিয়া। এছাড়াও ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর সদরের ৩ জন, নাটিমার ১ জন, গোকুলনগরের দুজন, গোবিন্দপুরের একজন জীবননগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মাধ্যমে নমুনা দিয়ে তাদের করোনা পজিটিভ হয়েছে।