চুয়াডাঙ্গাসহ সারাদেশে উৎসব মুখর টিকাদান : মেহেরপুরে গণটিকা কেন্দ্র পরিদর্শনকালে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী
স্টাফ রিপোর্টার: উৎসব-মুখর পরিবেশে এক কোটি টিকাদান কর্মসূচির প্রথম দিন শেষ হলো। চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপরসহ দেশের প্রতিটি অস্থায়ী টিকাদান বুথ, কেন্দ্র, ক্লিনিক, হাসপাতালে দীর্ঘ লাইন দেখা গেছে। সারাদিন টিকা গ্রহণ করেছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। কোনো ধরনের কাগজ বা রেজিস্ট্রেশন ছাড়াই করোনার প্রথম ডোজ পেয়ে খুশি তারা। তবে ভোগান্তিও দেখা গেছে কোথাও কোথাও। টিকা নিতে আসা মানুষের ঢল নামায় একাধিক কেন্দ্রে কমবেশি ভোগান্তি লক্ষ্য করা গেছে। এদিকে আরও দুইদিন এই কার্যক্রম চালানোর ঘোষণা দিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
আগেই ঘোষণা দেয়া হয়েছিল একদিনে এক কোটি মানুষকে টিকা দেয়া হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কেউ কেউ বলেছিলেন ২৬ ফেব্রুয়ারির পর আর প্রথম ডোজ টিকা দেয়া হবে না। এমন ঘোষণায় গতকালের ক্যাম্পেইনের আগের দিনগুলোতে ব্যাপক ভিড় দেখা দেয় কেন্দ্রগুলোতে। গতকাল ভোর হতেই টিকা নিতে লাইনে দাঁড়ায় মানুষ। টিকা দেয়ার শুরুর আগে শত শত মানুষ ভিড় করে কেন্দ্রে। এতে বিভিন্ন কেন্দ্রে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে টিকা দেন অনেকে।
এদিকে শনিবার শুরু হওয়া করোনার গণটিকাদান কার্যক্রম আগামী সোমবার পর্যন্ত বাড়ানোর কথা জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভ্যাকসিন ডেপ্লয়মেন্ট কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা। গতকাল তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, আগামী ২৮ তারিখ পর্যন্ত ক্যাম্পেইনের আওতায় টিকা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। টিকা নিতে আসা মানুষের ভিড়ের কারণে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। যেসব টিকাকেন্দ্রে ভিড় বেশি থাকবে সেসব কেন্দ্রে দুইদিন টিকা দেয়া হবে। কোনো কোনো কেন্দ্রে দুইদিন টিকা দেয়া হবে সে বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসন সিদ্ধান্ত নেবে। তবে দিনভর ভোগান্তির মধ্যেই শনিবার বেলা তিনটার দিকে মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার গড়পাড়া ইউনিয়ন পরিষদে গণটিকা কার্যক্রম অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানিয়েছেন, ভয়ের কোনো কারণ নেই, আজকের পরও প্রথম ডোজসহ সকল ডোজই চালু থাকবে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, এ নিয়ে বিভ্রান্তির কোনো সুযোগ নেই। আমাদের কাছে প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত টিকা রয়েছে। যত টিকাই লাগে আমরা দিতে পারবো। টিকা অতিরিক্ত হয়ে গেলে আমরা অন্য যেসব দেশ টিকা পায়নি, তাদের দিয়ে দিতে পারবো। মন্ত্রী বলেন, শনিবারের বিশেষ এই টিকা কার্যক্রমে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। গণটিকার আজকের কার্যক্রম সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। আজকের এই বিশেষ টিকা কার্যক্রমের মধ্যদিয়ে দেশে টিকা গ্রহণকারীর সংখ্যা হবে প্রায় ১২ কোটি।
চুয়াডাঙ্গায় সফল ভাবে করোনার জন্য গণটিকা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। টিকা কেন্দ্রগুলোতে সাধারণ মানুষের ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। একদিনে জেলার এক লাখ মানুষকে গণটিকার আওতায় আনা হবে। শনিবার সকাল থেকে চুয়াডাঙ্গার ১৮৭টি কেন্দ্র সব বয়সের মানুষের টিকা প্রদান কার হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায় চুয়াডাঙ্গা জেলার সদর হাসপাতালে সকালে টিকা নিতে সাধারণ মানুষের ভিড়। অনলাইন নিবন্ধন ব্যতীত ভোটার আইডি কার্ড দিয়ে সহজেই টিকা দিতে পেরে খুশি অনেকেই।
এদিকে চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এলাকায় দেখা যায় লম্বা লাইন ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে গণটিকা নিচ্ছেন জনগণ। চুয়াডাঙ্গার সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, শনিবার সকাল ৯টা থেকে জেলার ১৮৭টি কেন্দ্রে এক যোগে শুরু হয় গণটিকার কার্যক্রম। যেখানে কাজ করছে প্রায় ৩ শতাধিক স্বাস্থ্যকর্মী। এছাড়া স্কাউট, রোভার ও রেডক্রিসেন্টের স্বেচ্ছাসেবীরা শৃঙ্খলার দায়িত্বে কাজ করছেন।
চুয়াডাঙ্গা জেলার সিভিল সার্জন ডা. সাজ্জাদ হাসান জানান, রেজিস্ট্রেশনের ঝামেলা ছাড়া শুধুমাত্র আইডি কার্ড, জন্মনিবন্ধন ও মোবাইল নম্বরের ভিত্তিতে করোনার প্রথম ডোজ টিকা নিতে পারবেন জেলার ১২ বছরের ওপেরর যে কোন বাসিন্দা। চুয়াডাঙ্গায় ৪ উপজেলা চুয়াডাঙ্গা সদর, আলমডাঙ্গা, দামুড়হুদা, জীবননগর উপজেলার ১৮৭ কেন্দ্রে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে গণ টিকাদান চলেছে ।
করোনার টিকা কার্যক্রমের কেন্দ্রগুলো পরিদর্শন করেছেন চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম খান, চুয়াডাঙ্গা সিভিল সার্জন ডা. সাজ্জাৎ হোসেন, চুয়াডাঙ্গা পৌর মেয়র জাহাঙ্গীর আলম মালিক খোকন, চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আসাদুল হক বিশ্বাস, উপজেলা নির্বাহী অফিসার শামীম ভূইয়া, উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. আওলিয়ার রহমানসহ স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তা কর্মচারীদের তত্ত্বাবধানে টিকা প্রদান করছে স্বাস্থ্যকর্মীবৃন্দ। ইউনিয়নের টিকা কেন্দ্রগুলোতে উপস্থিত থেকে স্বাস্থ্য কর্মীদের সহযোগিতা করছেন কেন্দ্রগুলোর ট্যাগ অফিসারসহ চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার আলুকদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাজি আবুল কালাম আজাদ, মোমিনপুরের আল মামুন রতন, পদ্মবিলার আলম হোসেন, শংকরচন্দ্রের আব্দুর রহমান, কুতুবপুরের আলী আহামেদ হাসানুজ্জামান মানিক, বেগমপুরের আলী হোসেন জোয়ার্দ্দার, গড়াইটুপির শফিকুর রহমান রাজু, তিতুদহের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান শুকুর আলী।
দামুড়হুদা অফিস/কার্পাসডাঙ্গা প্রতিনিধি জানিয়েছেন, দামুড়হুদা উপজেলার আয়োজনে আনুষ্ঠানিক গণটিকা কার্যক্রমের শুরু হয়েছে। দামুড়হুদা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আলি মুনছুর বাবু প্রধান অতিথি হিসেবে থেকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে গণটিকা কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন দামুড়হুদা উপজেলা সহকারী কমিশনার ভূমি সুদীপ্ত কুমার সিংহ, আব্দুল ওদুদ শাহ ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ কামাল উদ্দীন, উপজেলা পাট কর্মকর্তা রিয়াজুল ইসলাম, দামুড়হুদা সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হযরত আলী। দামুড়হুদা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আবু হেনা মোহাম্মদ জামাল জানান, খুবই উৎসবমুখর ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে উপজেলার ৮টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা থেকে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ১৯ হাজার ১৭১ জন মানুষ করোনা প্রতিষোধক টিকা গ্রহণ করেছেন। প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদ ও দর্শনা পৌরসভার পক্ষ থেকে টিকা গ্রহণকারীদের আনা নেয়ার জন্য ভ্যানগাড়ির ব্যবস্থা ছিলো। যার ফলে সাধারণ মানুষ উৎসাহী হয়ে টিকা গ্রহণ করেন। টিকা কেন্দ্রগুলোর আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে আনসার বাহিনীর সদস্যরা নিযুক্ত ছিলেন। দর্শনা পৌর মেয়র, কাউন্সিলর ও ৮টি ইউপির চেয়ারম্যান-মেম্বাররা সার্বিক সহযোগিতা করেছেন গণটিকা কার্যক্রম পরিচালনায়। তিনি আরও বলেন, গণটিকা কার্যক্রম পরিচালনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দামুড়হুদা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আলি মুনছুর বাবু, উপজেলা সহকারী কমিশনার ভূমি সুদীপ্ত কুমার সিংহ, দামুড়হুদা মডেল থানার ওসি ফেরদৌস ওয়াহিদ, দর্শনা পৌর সভার মেয়র মতিয়ার রহমান, পারকৃষ্ণপুর-মদনা ইউপি চেয়ারম্যান এসএএম জাকারিয়া আলম, জুড়ানপুর ইউপি চেয়ারম্যান সোহরাব হোসেন, দামুড়হুদা সদর ইউপি চেয়ারম্যান হযরত আলী, হাউলী ইউপি চেয়ারম্যান নিজাম উদ্দীন, কার্পাসডাঙ্গা ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল করিম, নাটুদহ ইউপি চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম, নতিপোতা ইউপি চেয়ারম্যান ইয়ামিন আলী, কুড়–লগাছি ইউপি চেয়ারম্যান কামাল উদ্দীনসহ সংশ্লিষ্টরা টিকার কেন্দ্রগুলো সার্বক্ষণিক পরিদর্শন করেন।
মেহেরপুর অফিস জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত সারাদেশে এক কোটি টিকাদান কর্মসূচির আওতায় মেহেরপুর জেলায় ৩১ হাজার ৩৯১ জনকে টিকা দেয়া হয়েছে। এরমধ্যে প্রথম ডোজ ২৫ হাজার ৭৯৬, দ্বিতীয়বার ৪ হাজার ৭৫০ এবং তৃতীয় ৮৪৫ জনকে প্রদান করা হয়েছে। শনিবার সকাল থেকে মেহেরপুর জেলার ৩টি উপজেলার ৫টি অস্থায়ী কেন্দ্রসহ মোট ৭২ টি কেন্দ্রে একযোগে টিকাদান পর্ব শুরু হয়। ৭২টি টিকাদান কেন্দ্রে জন্য ১৪৪ জন কর্মী এবং ২১৬ জন ভলেন্টিয়ার টিকাদানকাজে সহযোগিতা করেন।
মেহেরপুর জেলা সিভিল সার্জন অফিসসূত্রে জানা গেছে, মেহেরপুর পৌর এলাকার ৯টি ওয়ার্ডে ১ হাজার ৮৪৯ জন, সদর উপজেলা ৯ হাজার ৩৬০ জন, গাংনী উপজেলার ১৪ হাজার ৮৪২ জন এবং মুজিবনগর উপজেলায় ৫ হাজার ৩৪০ জনকে টিকা দেয়া হয়। এদিকে টিকাদান পর্ব চলাকালীন সময়ে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন, জেলা প্রশাসক ড. মুহাম্মদ মুনসুর আলম খান, সিভিল সার্জন ডা. জওয়াহেরুল আনাম সিদ্দিকী, পৌর মেয়র মাহফুজুর রহমান রিটন বিভিন্ন টিকাদান কেন্দ্র পরিদর্শন করেন। টিকা কেন্দ্র পরিদর্শনকালে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, দেশে আর লকডাউনের প্রয়োজন হবে না, জোর দেয়া হবে টিকা কার্যক্রম ও মাস্ক পরায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শিতায় দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণ টিকা মজুদ করা হয়েছে, যা বিশ্বের অনেক দেশ করতে ব্যর্থ হয়েছে। শুধু তাই নয়, বিনামূল্যে টিকা কার্যক্রমের পাশপাশি করোনার পরীক্ষা ও চিকিৎসায় নজির স্থাপন করেছে বর্তমান সরকার। যার সুফল ভোগ করছে দেশবাসী। করোনার সংক্রমণ নেমে এসেছে ৫ শতাংশের নিচে। ভবিষ্যতে আর লকডাউনের মতো কঠোর বিধিনিষেধ দেয়ার প্রয়োজন হবে না। প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, সাধারণ মানুষকে মাস্ক পরতে হবে। মাস্ক না পরলে আবারও করোনার সংক্রমণ বেড়ে যেতে পারে। শুধু মাস্কই পারে করোনার সংক্রমণ কমানোর পাশপাশি ফুসফুসের নানা রোগ থেকে মানুষকে রক্ষা করতে। এ ছাড়া মাস্ক পরলে অন্য ভাইরাস থেকেও মানুষ মুক্ত থাকবে। তাই লকডাউন না দিয়ে মানুষকে মাস্ক পরার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে হবে। এর আগে শনিবার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে মন্ত্রী জেলা সার্কিট হাউসে পৌঁছুলে পুলিশের একটি দল তাকে গার্ড অব অনার প্রদান করে। পরে শহরের স্টেডিয়াম মাঠে গণটিকা কার্যক্রম পরিদর্শন করেন তিনি।
এদিকে সকাল থেকে জেলার টিকা কেন্দ্রগুলোয় জড়ো হন প্রচুর মানুষ। বিভিন্ন বয়সের মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে টিকা নেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত টিকা প্রদান করা হবে বলে জানায় জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ।
পূর্ববর্তী পোস্ট
এছাড়া, আরও পড়ুনঃ