মুখে মাস্ক ব্যবহার না করে হরহামেশা ঘোরাঘুরি করছে মানুষ
স্টাফ রিপোর্টার: করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের মুখে দেশ। আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। একই সঙ্গে নতুন ভেরিয়েন্ট ওমিক্রনের দাপটে বাড়ছে উৎকণ্ঠা। প্রতিদিনই বাড়ছে শনাক্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। সংক্রমণ মোকাবিলায় নতুন করে ১১ দফা বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। আরোপিত বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে পাড়া কিংবা মহল্লা, হাসপাতাল, গণপরিবহন, রেস্তরোঁ, বিপণিবিতান ও মূল সড়কসহ কোথাও যেন নেই স্বাস্থ্যবিধির বালাই। মুখে মাস্ক ব্যবহার না করে হরহামেশা ঘোরাঘুরি করছে মানুষ। বিধিনিষেধের প্রথম দিনে মাস্ক না পরাদের তেমন শাস্তির আওতায় আনতে দেখা যায়নি। কেউ কেউ মাস্ক পরা একেবারে ছেড়েই দিয়েছে। সুযোগ পেলেই চায়ের দোকানে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ব্যাপারে নেই কোনো সচেতনতা। গতকাল বৃহস্পতিবার বিধিনিষেধের প্রথম দিন বিভিন্ন এলাকায় দেখা গেছে এমন চিত্র। আরোপিত বিধিনিষেধে দোকান, শপিং মল ও বাজারে ক্রেতা-বিক্রেতা এবং হোটেল- রেস্তরাঁসহ সকল জনসমাগম স্থলে বাধ্যতামূলক সবাইকে মাস্ক পরতে বলা হয়েছে। রেস্তরাঁয় বসে খাবার গ্রহণ এবং আবাসিক হোটেলে থাকার জন্য করোনার টিকা সনদ প্রদর্শন করার নির্দেশও দিয়েছেন সরকার। কিন্তু স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করেই মূল সড়ক, অলিগলি, হাসপাতাল, রেস্টুরেন্ট, টার্মিনাল, শপিংমলসহ বিভিন্ন জায়গায় স্বাস্থ্যবিধি উধাও। বাসে গাদাগাদি করে যাত্রী উঠছে। মাস্ক না পরে যাত্রীরা যেন যানবাহনে না ওঠেন, সে বিষয়ে সরকারের নির্দেশনা থাকলেও দু-একজন ছাড়া প্রায় যাত্রীর মুখে মাস্ক নেই। হাসপাতাল, শপিংমলের চিত্রও একই। পরিবহন শ্রমিকদের বেশির ভাগের মুখে মাস্ক ছিলো না। ছোট-বড় হোটেলগুলোতে হরহামেশা চলছে ক্রেতাদের আনাগোনা। বিধিনিষেধে টিকা কার্ড দেখানোর কথা থাকলেও নিয়ম মানতে দেখা যায়নি কাউকে।
জীবাণুনাশকের ব্যবহারও দেখা যায়নি। হুড়োহুড়ি করে বাসে উঠছেন যাত্রীরা। হাসপাতালে রোগীর স্বজনদের নেই কোনো স্বাস্থ্যবিধি ও সচেতনতা। একসঙ্গে গাদাগাদি করে হাসপাতালে প্রবেশ করছেন। সরকারি হাসপাতালের টিকিট কাউন্টারের সামনে দীর্ঘ লাইন। রাত হলে হাসপাতালের মেঝেতে পাশাপাশি ঘুমোচ্ছেন রোগীর স্বজনরা। গলির চায়ের দোকান ও শপিংমলগুলোর চিত্র আরও ভয়াবহ।
করোনার শুরু থেকে সব জায়গায় মুখে মাস্ক ব্যবহার এবং হাত ধোয়ার জন্য পর্যাপ্ত সাবান-পানি ও জীবাণুনাশকের ব্যবস্থা রাখার নির্দেশনা দিয়েছিলো সরকার। যাত্রা শুরু ও শেষে যানবাহন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা ও জীবাণুনাশক দিয়ে জীবাণুমুক্ত করার ব্যবস্থা রাখার কথাও বলা হয়েছিলো। বিভিন্ন হাসপাতাল ও শপিংমলের প্রবেশমুখে জীবাণুনাশক টানেল বসালেও এখন তা নেই। বিভিন্ন কাঁচাবাজারে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ঘুরে দেখা যায়, সেই করোনা শুরুর আগের চিত্র। ক্রেতা-বিক্রেতাদের অধিকাংশের মুখে মাস্ক নেই। ক্রেতারা স্বাস্থ্যবিধি না মেনে কেনাকাটা করছেন। সকাল থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে দেখা গেছে টিকিট কাউন্টারের সামনে দীর্ঘ লাইন। দু-একজন ছাড়া কারও মুখে মাস্ক নেই। কোথাও কোথাও চালক- হেলপারদের মুখেও মাস্ক দেখা যায়নি। অনেকের মাস্ক পরায় অনীহা তৈরি হয়েছে। কেউ আবার গলায় মাস্ক ঝুলিয়ে, আবার নাকের নিচে মাস্ক রেখে ঘুরছেন। কেউ পকেটে রেখে দিয়েছেন। অনেকে মুখে মাস্ক পরাই ছেড়ে দিয়েছেন। বেশির ভাগ লোকজনেরই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে আগ্রহ দেখা যায়নি। স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে লোকজন চরম উদাসীন। করোনার নতুন ধরন শনাক্তের ব্যাপারও অনেকের অজানা।
এক সবজি বিক্রেতা বলেন, মাস্ক এখন আর পরি না। সারাদিন ক্রেতাদের ডাকতে হয়। মুখে মাস্ক রাখলে কষ্ট হয়। দম বদ্ধ হয়ে আসে। এতোদিনে করোনায় তো কিছু হয়নি। আমাদের গরিবদের কিছু হবে না। প্রথমে ভয়ে মাস্ক পরতাম। এখন আর ভয় পাই না। জরিমানা গুনতে হলে গুনবো। এদিকে চায়ের দোকানে চা খেতে খেতে আমজাদ হোসেন নামের এক ব্যক্তি বলেন, মুখে মাস্ক পরলে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। প্রথম দিকে মাস্ক পরেছি। এখন করোনা নেই, মাস্ক কাছে রাখিও না।
একটি খাবার হোটেলের ম্যানেজার বলেন, সকাল থেকে যে যারা খেতে এসেছেন কেউই বিধিনিষেধ মানছে না। একজনও টিকা কার্ড দেখাননি। প্রথমদিনে মানুষের মধ্যে বিধিনিষেধ মানার কোনো উৎকণ্ঠা দেখিনি। এদিকে এতো নিয়ম-কানুন মানলে ক্রেতা কম আসে। করোনায় আমাদের সব শেষ করে দিয়েছে। এখন ক্রেতা না আসলে আমরা পরিবার নিয়ে বাঁচবো কি করে? হোটেলে খেতে আসা এক ব্যক্তি বলেন, করোনার সনদ নিয়ে কি সব সময় ঘোরা যায়? টিকা নিয়েছি এটাই শেষ কথা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি বলেন, গত বছর আমি নিজেও আক্রান্ত হয়েছিলাম। হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। হাসপাতালে দেখেছি আশেপাশে অনেকে মারা গেছেন। একবার আক্রান্ত হয়ে বুঝতে পেরেছি কষ্ট কেমন। ভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে হলে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। করোনা শুরুর দিকে মানুষের মধ্যে সচেতনতা দেখা গেলেও এখন লোকজন এ ব্যাপারে একেবারে উদাসীন। শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সচেতন কেউই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখে না। হাতেগোনা কয়েকজন মানুষ মাস্ক পরে। নতুন ভ্যারিয়েন্ট সম্পর্কে মানুষের ধারণাও নেই।
৫৫ বছরের দিনমজুর আনিচ উদ্দীন বলেন, আগে করোনাকে ভয় পেতাম এখন আমাদের কর্ম করে খেতে হয়। করোনার ভয় পেলে পেটের ক্ষুধা মিটবে না। মরলে মরে যাবো। বিধিনিষেধ মেনে চললে সরকার কি খাবার দিয়ে যাবে। শপিংমলে ছেলেমেয়েকে নিয়ে এসেছেন নাজমা খাতুন। তিনি বলেন, আগে সব সময় মাস্ক পরতাম। এখন মাঝে মাঝে পরি। সব সময় মাস্ক পরতে ভালো লাগে না। এখন তো দেখি কোথাও কোনো স্বাস্থ্যবিধি ও সচেতনতা নেই। বাস, শপিংমলে জীবাণুনাশক হ্যান্ড স্যানিটাইজার বা হাত ধোয়ার ব্যবস্থা থাকার কথা। কিন্তু কোথাও এ ধরনের কিছুই দেখি না। থাকলেও কার্যকর নেই। নতুন-পুরান যাই আসুক আমাদের কিছু হবে না।
কোর্টমোড়ে বান্ধবীর জন্য অপেক্ষা করতে দেখা গেছে মীম রহমানের। দুই বান্ধবী মিলে কেনাকাটা করতে যাবেন। মুখে মাস্ক পরা। তিনি বলেন, করোনার শুরু থেকেই মাস্ক ছাড়া বাইরে বের হই না। মাঝে একটু কম পরতাম। এখন আবার সব সময় পরা শুরু করেছি। করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্টে নাকি কয়েকজন আক্রান্ত হয়েছেন। সচেতন থাকলে তো সমস্যা নেই। নতুন ভ্যারিয়েন্টে শনাক্তের সংখ্যাও নাকি বেড়েছে। এক অটোচালক বলেন, কেউ কিনে দিলে মাস্ক পরি, না দিলে পরি না। নতুন করোনা সম্পর্কে এখনো জানি না। আমাদের কাজ করে খেতে হয়। করোনার খবর রাখার সময় নেই।
চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভাইকে নিয়ে এসেছেন তানিয়া। সঙ্গে এসেছেন স্বজনরাও। কারও মুখে মাস্ক নেই। নেই কোনো সচেতনতা। তানিয়া বলেন, মুখে মাস্ক রাখতে এখন আর ভালো লাগে না। আগে বাসার বাইরে বের হলেই মাস্ক পরতাম। এখন বিরক্ত লাগে। আবার নাকি করোনার নতুন ধরন শনাক্ত হয়েছে।
পূর্ববর্তী পোস্ট
এছাড়া, আরও পড়ুনঃ