পিকে হালদার ভারতে গ্রেফতার : দুই ভাইসহ ৫ জন ইডির নিরাপত্তা হেফাজতে
বন্দি বিনিময় চুক্তির আওতায় বাংলাদেশে ফেরত আনা হবে-স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী
স্টাফ রিপোর্টার: নাম-পরিচয় লুকিয়েও রেহাই পেলেন না পিকে হালদার (প্রশান্ত কুমার হালদার)। বাংলাদেশ থেকে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা পাচারে জড়িত পিকে হালদারসহ ছয়জনকে গ্রেফতার করেছে ভারতের অর্থসংক্রান্ত গোয়েন্দা সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। গতকাল শনিবার পশ্চিমবঙ্গের অশোক নগরের একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়। শিবশংকর হালদার নামে মাছ ব্যবসায়ী পরিচয়ে ওই এলাকায় তিনি লুকিয়ে ছিলেন। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে পিকের সহযোগী হিসাবে তার দুই ভাইসহ চারজন ও সুকুমার মৃধার মেয়েও আছে। এদিন বিকেলে তাদের কোলকাতার ব্যাঙ্কশাল কোর্টে তোলা হলে তদন্তের স্বার্থে পিকে হালদার ও তার দুই ভাইসহ পাঁচজনকে ১৭ মে পর্যন্ত ইডির হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন অবকাশকালীন মুখ্য দায়রা বিচারক। তবে সুকুমার মৃধার মেয়ে অনিন্দিতাকে একই তারিখ পর্যন্ত জেলহাজতে রাখার নির্দেশ দেন তিনি। ইডি দুদিন অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ সম্পদের দলিল ও নথিপত্র উদ্ধার করে। এ সময় সিলগালা করা হয়েছে অন্তত ১০টি বিলাসবহুল বাড়ি।
এদিকে সহযোগীসহ পিকে হালদারকে গ্রেফতারের ঘটনায় বাংলাদেশ ও ভারত দুদেশেই চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রধান কৌঁসুলি খুরশীদ আলম খান শনিবার বিকেলে সাংবাদিকদের বলেন, তারা পিকে হালদারের ভারতে আটক হওয়ার খবরটি পেয়েছেন। তিনি বলেন, পিকের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের ৩৪টি মামলা রয়েছে। তার মধ্যে ৩টি মামলায় তদন্ত কার্যক্রম শেষ। বাকি ৩১টি মামলায় তদন্ত অনেকদূর এগিয়েছে। তাকে বাংলাদেশে ফেরত আনা হলে জিজ্ঞাসাবাদ করে দ্রুত বাকি সব মামলায় চার্জশিট দেয়া সম্ভব হবে। অপরদিকে গণমাধ্যমে তাদের গ্রেফতারের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর প্রতিক্রিয়া দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন। আলাদা দুই অনুষ্ঠানে এ দুই মন্ত্রী জানান, তারা আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রেফতারের খবর পাননি। তবে বিভিন্ন মাধ্যমে গ্রেফতারের খবর জেনেছেন। বন্দি বিনিময় চুক্তি কার্যকর থাকায় তাকে (পিকে) দ্রুত দেশে আনা সম্ভব হবে বলেও মন্তব্য করেন তারা।
এর আগে বাংলাদেশ থেকে দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পিকে হালদারের সম্পদের খোঁজে শুক্রবার থেকে অভিযান শুরু করে ইডি। শনিবার পশ্চিমবঙ্গের অশোক নগরের একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তাকেসহ ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিরা হলেন, পিকে হালদারের দুই ভাই-প্রিতিশ কুমার হালদার ও দানেশ কুমার হালদার, দুই সহযোগী স্বপন মৈত্র ও উত্তম মৈত্র। এছাড়াও রয়েছেন সুকুমার মৃধার মেয়ে অনিন্দিতা। ভারতীয় গোয়েন্দাদের জালে ধরা পড়ার পর স্থানীয় গণমাধ্যমের ক্যামেরার সামনে মুখ লুকোনোর চেষ্টা করেন পিকে হালদার। বারবার হাত দিয়ে নাক ও মুখ ঢাকার ব্যর্থ চেষ্টা চালান। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে প্রিতিশ কুমার হালদার ও দানেশ কুমার হালদার নিজেদের পিকের দুই ভাই বলে স্বীকার করেন। তবে পিকে হালদার কী ধরনের ব্যবসা করেন তা তারা জানেন না বলে উত্তর দেন। অপরদিকে উত্তম মৈত্রের স্ত্রী স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছে স্বীকার করেন, তারা বাংলাদেশ থেকে এক থেকে দেড় বছর আগে ভারতে এসে বসবাস করছেন। ইডি জানিয়েছে, শিবশংকর হালদার নামে ভারতের লুকিয়ে ছিল পিকে হালদার। নিজেকে মাছ ব্যবসায়ী পরিচয়ে দেশটির নাগরিত্ব, আধারসহ বিভিন্ন কার্ডও সংগ্রহ করেছেন। ওই কার্ড দিয়ে খুলেছেন বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও। তারা মাছ ব্যবসায়ী পরিচয়ে বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার করতেন বলেও জানানো হয়েছে।
সূত্রমতে, পিকে হালদারকে গ্রেফতারের পরই প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে অর্থ পাচারের নানা তথ্য পেয়েছেন ইডির গোয়েন্দারা। বাংলাদেশ থেকে কীভাবে দেশের বাইরে অর্থ পাচার করেছেন এবং কোথায় কোথায় বিনিয়োগ করেছেন তা নিয়ে একের পর এক তথ্য বেরিয়ে আসছে। জেরায় পিকে হালদারের ঘনিষ্ঠ তথা অর্থ পাচার চক্রে যুক্ত বাংলাদেশে বসবাসকারী কজনের নামও উঠে এসেছে। ওই নাম ও তথ্য বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী সংস্থাকে পাঠিয়ে দেওয়া হবে বলে জানান তারা। শুক্রবারের পর শনিবারও অভিযানের সূত্র ধরে পশ্চিমবঙ্গে হালদারের কেনা আরও বিপুল পরিমাণ সম্পদের সন্ধান মিলেছে। একই সঙ্গে জেরায় পিকে হালদারের ঘনিষ্ঠ বেশ কজনের নামও উঠে এসেছে বলে এদিন কোর্টে ইডির গোয়েন্দারা জানিয়েছেন। সূত্র আরও জানায়, পিকের সহযোগী স্বপন মিত্রের অশোকনগরের বাড়ি থেকে অর্থ পাচারসংক্রান্ত একাধিক নথিও উদ্ধার করেছেন গোয়েন্দারা। পরে দীর্ঘ জেরার পর তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ধরা পড়া ছয়জনের পাশাপাশি অবশ্য আরও কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ইডি ইতোমধ্যে আটক করেছে। ইডির একাধিক সদস্যের সঙ্গে আলাপচারিতায় জানা গেছে, বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে তথ্য পেয়ে শুক্রবারই উত্তর ২৪ পরগনার অশোকনগরের পাশাপাশি দক্ষিণ ২৪ পরগনা ও কলকাতার নয়টি ঠিকানায় তল্লাশি চালানো হয়। আর তখনই পিকে হালদারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও আত্মীয়স্বজনের নামে আরও বেশ কয়েকটি বাড়ির সন্ধান মেলে।
ইডি জানায়, পিকে হালদার নিজেকে শিব শঙ্কর হালদার নামে ভারতীয় নাগরিক হিসাবে পরিচয় দিতেন। বাংলাদেশি এই অর্থ পাচারকারী পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য থেকে ভারতীয় রেশন কার্ড, ভারতীয় ভোটার আইডি কার্ড, প্যান এবং আধার কার্ডও সংগ্রহ করেছিলেন। পিকে হালদারের অন্য সহযোগীরাও ভারতীয় এসব কার্ড জালিয়াতির মাধ্যমে সংগ্রহ করেন। এসব কার্ড দেওয়ার সঙ্গে জড়িতদের বিষয়েও খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে।
এর আগে পিকে হালদার এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। তার বিরুদ্ধে চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুদক। পিকে হালদার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে অদ্যাবধি ৩৪টি মামলা হয়েছে। এছাড়া ৮৩ ব্যক্তির ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করা হয়েছে। প্রায় এক হাজার কোটি টাকা মল্যের স্থাবর সম্পদ (জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাট ইত্যাদি) ক্রোক করা হয়েছে। ২৫ জন আসামি ও অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞাও জারি করা হয়েছে। এছাড়া এসব মামলায় আদালতে ১১ জন আসামি ১৬৪ ধারায় দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন। পিকে হালদার বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার পর তার অবৈধ সম্পদ দেখাশোনা করতেন সুকুমার ও অনিন্দতা মৃধা? পিকে হালদারের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানও করেন সুকুমার মৃধা?
জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে পাওয়া তথ্যের সূত্র ধরেই শুক্রবার থেকে অভিযান চালায় এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। শনিবারও অভিযান চলে। গ্রেফতারকৃত পিকে হালদার ও তার পাঁচ সহযোগীকে এদিন বিকালে কলকাতার ব্যাঙ্কশাল কোর্টে তোলা হয়। তদন্তের স্বার্থে বিচারক তাদের ইডির হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। আরও জানা গেছে, অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ মাথায় নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমানো এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক পিকে হালদারের সন্ধান শুক্রবার রাতেই পেয়েছিল ইডি। অশোকনগরে একটি বাড়িতে নাম ও পরিচয় লুকিয়ে তিনি বসবাস করছিলেন বলে দাবি গোয়েন্দাদের। তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও পাচার হওয়া অর্থের মূল নিয়ন্ত্রক সুকুমার মৃধাই হালদারকে নিয়মিত খরচ জোগাত। তার সহযোগীদের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হয়ে শনিবার পিকে হালদারকে গ্রেফতার করা হয়।
বাংলাদেশে সুকুমার মৃধা পিকে হালদারের আইনজীবী ও তার অর্থ দেখভাল করতেন। কিন্তু তিনি উত্তর চব্বিশ পরগনার অশোকনগরে মাছ ব্যবসায়ী হিসাবে পরিচিত ছিলেন। পিকে হালদারের পাচার হয়ে আসা বিপুল অর্থ দিয়ে ওই অশোকনগরে কয়েকটি মাছের ভেড়ি কিনেছিলেন সুকুমার। সুকুমারের মেয়ে অনিন্দিতার স্বামী সঞ্জীব হাওলাদারও বাংলাদেশি নাগরিক। স্বভাবতই পশ্চিমবঙ্গে বিদেশি নাগরিকদের বেআইনিভাবে বসবাস করার অভিযোগেও একটি পৃথক মামলা হবে বলে পুলিশের দাবি। পিকে হালদারের ভাই এনআরবি-কা-ে আরেক অভিযুক্ত প্রিতিশ হালদারের নামে একটি প্রাসাদোপম বাগানবাড়ি ক্রয় করা হয়েছিল অশোকনগরেই। বছর দুই আগে ওই বাগানবাড়িটি অন্য ব্যক্তির কাছে হস্তান্তর করেন প্রিতিশ। বর্তমানে ওই বাড়িতেই থাকতেন সুকুমারের জামাই সঞ্জীব।