মাথাভাঙ্গা মনিটর: তুরস্ক ও সিরিয়ায় শক্তিশালী ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। দেশ দুটিতে নিহতের সংখ্যা ১১ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনো হাজার হাজার মানুষ আটকে থাকায় মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। জীবিতদের উদ্ধারের আশায় উদ্ধারকর্মীরা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু সময় যত যাচ্ছে, ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে থাকা লোকদের জীবিত উদ্ধারের আশা ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে আসছে। তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা ১১ হাজার ২০০ ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে দক্ষিণ তুরস্কে ৮ হাজার ৫৭৪ জন এবং উত্তর সিরিয়ায় ২ হাজার ৫৩০ জন মারা গেছেন। ভয়াবহ ভূমিকম্পে তুরস্কের ১০টি শহরের ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সিরিয়ায় উদ্ধার অভিযানে সমস্যা বাড়তে শুরু করেছে। রাস্তাঘাট ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় তুরস্ক থেকে সেখানে জাতিসংঘের জরুরি সাহায্য পাঠানোর পথ বন্ধ হয়ে গেছে।
সোমবারের ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পে তুরস্ক ও সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলের হাজার হাজার ঘরবাড়ি, হাসপাতাল, স্কুল ধসে পড়েছে। এতে হাজার হাজার মানুষ আহত হয়েছে। অগণিত মানুষ উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছে। বৈরী আবহাওয়া, সড়ক ধসেপড়া এবং ভারী যন্ত্রপাতির অভাবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় পৌঁছুনো ও সেখানে উদ্ধারকাজ চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে উদ্ধারকর্মীদের। ভূমিকম্পের ৬০ ঘণ্টা পর দুই দেশে প্রায় ৮০ হাজার উদ্ধারকর্মী কাজ করছেন।
বিবিসির মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক সংবাদদাতা অ্যানা ফস্টার তুরস্কের ওসমানিয়া শহর থেকে ধ্বংসস্তূপের বর্ণনা দিয়েছেন। শহরটি ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলের কাছেই। বৃষ্টির কারণে উদ্ধার তৎপরতা ব্যাহত হচ্ছে। রাতে শহরটিতে কোনো বিদ্যুৎ ছিল না। প্রবল শীতের মধ্যে দুর্গতরা খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাচ্ছেন। কয়েকদিন ধরে তুরস্ক ও সিরিয়ার জনগণের চোখে ঘুম নেই। এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আটকেপড়া ব্যক্তিদের আত্মীয়রা ধ্বংসস্তূপের পাশে অপেক্ষা করছেন। তাদের আশা, স্বজনদের হয়তো জীবিত খুঁজে পাওয়া যাবে। কিন্তু তীব্র শীতের কারণে উদ্ধার প্রচেষ্টা কঠিন হয়ে উঠেছে। গৃহহীনদের দুর্দশা বেড়েছে। কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নেই।
ইস্তাম্বুলের তুর্কি সাংবাদিক ইব্রাহিম হাসকোলোলু বলেন, লোকরা এখনো ধসেপড়া ভবনের নিচে রয়েছে, তাদের সাহায্যের প্রয়োজন। তিনি বলেন, ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে আটকেপড়া লোকজন তাকে ও অন্য সাংবাদিকদের ভিডিও, ভয়েস নোট এবং তাদের লাইভ অবস্থান পাঠাচ্ছে। তারা আমাদের বলছে, তারা কোথায় আছে এবং আমরা তাদের জন্য কিছুই করতে পারছি না। তিনি বলেন, তুরস্কের জন্য এখন আন্তর্জাতিক সহায়তা প্রয়োজন। ইতোমধ্যে বিধ্বস্ত দুই দেশে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ত্রাণসামগ্রী পাঠানো হচ্ছে।
কাহরামানমারাস শহরে আলী সাগিরোগ নামে এক ব্যক্তি সাংবাদিকদের কাছে জরুরি সেবা পাওয়া নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, আমি আমার ভাইকে ধ্বংসস্তূপ থেকে বের করে আনতে পারছি না। আমার ভাগনেকে ফেরাতে পারছি না। চারদিকে দেখুন, এখানে কোনো সরকারি কর্মকর্তা নেই। তিনি বলেন, আমি গত দুদিনে এখানে কোনো সরকারি লোক দেখিনি। বাচ্চারা ঠা-ায় জমে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকেপড়া লোকদের বের করে আনতে যত দেরি হবে, তাদের জীবিত উদ্ধারের সম্ভাবনা তত কমে আসবে। যুক্তরাষ্ট্রের ডিউক ইউনিভার্সিটির জরুরি সেবা বিশেষজ্ঞ ড. রিচার্ড এডওয়ার্ড মুনের মতে, পানি ও অক্সিজেনের স্বল্পতাই ভুক্তভোগীদের বেঁচে থাকার পথে প্রধান বাধা। তিনি বিবিসিকে বলেন, একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের শরীর থেকে দৈনিক ১ দশমিক ২ লিটার পর্যন্ত পানি বেরিয়ে যেতে পারে। এটি ঘটতে পারে প্রস্রাব, নিঃশ্বাস, জলীয়বাষ্প ও ঘামের মাধ্যমে। ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকেপড়া লোকদের শরীর থেকে এরই মধ্যে প্রচুর পানি বেরিয়ে গেছে। এ অবস্থায় একজন মানুষ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার ওপর, সিরিয়া-তুরস্কে এখন চলছে শীতকাল। একজন গড়পড়তা প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের শরীর উষ্ণ থাকার ক্ষমতা না হারিয়ে সর্বনিম্ন ২১ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে।
সময় ফুরানোর আগেই জীবিতদের উদ্ধারে প্রাণান্তকর চেষ্টা স্বেচ্ছাসেবীদের : সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়া মানুষদের উদ্ধারে সাধ্যমতো চেষ্টা চালাচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবীরা। উদ্ধার সরঞ্জামের জন্য অপেক্ষা না করেই হাতের কাছে যে যা পাচ্ছেন তা দিয়েই চলছে খোঁড়াখুঁড়ি। এরই মধ্যে দুর্যোগস্থলে পৌঁছেছে ৬৫ দেশের তিন হাজার স্বেচ্ছাসেবী এবং দক্ষ ফায়ার ব্রিগেড কর্মী। নিখোঁজদের সন্ধানে তাদের সঙ্গে রয়েছে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ডগ স্কোয়াড। তুরস্কের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, জোরালো ভূমিকম্পে সাড়ে ১১ হাজারের মতো ঘরবাড়ি-স্থাপনা ভেঙে পড়েছে। যেগুলোর ধ্বংসস্তূপ থেকে এখন পর্যন্ত ৩২ হাজার মানুষকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিতেও হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলো।
ভূমিকম্পের প্রায় ৪৫ ঘণ্টা পর ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে এক শিশুকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। মঙ্গলবার রাতে তুরস্কের সীমান্তবর্তী হেতে শহরের একটি ভবন থেকে শিশুটিকে বের করা হয়। মোহাম্মদ আহমেদ নামের বাচ্চাটিকে জীবিত পেয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন উদ্ধারকারীরা। দীর্ঘ সময় চাপা পড়ে থাকার পরও মোটামুটি অক্ষত ছিল সিরিয় শরণার্থী শিশুটি। বের করে আনার আগে পানি খাওয়ানো হয় তাকে। এদিকে সিরিয়ার পরিস্থিতি আরও খারাপ। বিদ্রোহী অধ্যুষিত এলাকা হওয়ায় মিলছে না ক্ষয়ক্ষতির সঠিক হিসাব। তবুও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হোয়াইট হেলমেটস চালিয়ে যাচ্ছে তৎপরতা।
তুরস্ক-সিরিয়ায় ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত ২ কোটি ৩০ লাখ মানুষ: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে-তাদের হিসাবে দুই দেশ মিলিয়ে দুই কোটি ৩০ লাখ মানুষ ভূমিকম্পের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে প্রায় ১০ লাখেরও বেশি শিশু রয়েছে বলে সংস্থাটি জানায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা অ্যাডেলহেইড মার্শাং বলেন, ওভারভিউ মানচিত্র দেখায় যে, এসব এলাকায় প্রায় ২৩ মিলিয়ন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৫০ লাখ দুর্বল জনগোষ্ঠী রয়েছে।