জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে দ্বিতীয় দিনের বৈঠক অনুষ্ঠিত
প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমাতে এনসিসি গঠন ও রাষ্ট্রের নাম বদলে সায় নেই বিএনপির
স্টাফ রিপোর্টার: প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাস করে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে ক্ষমতার ভারসাম্য আনার লক্ষ্যে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের বিষয়ে একমত নয় বিএনপি। দলটির মতে, এটা বাস্তবায়ন হলে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা অনেক বেশি সংকুচিত হবে। সেক্ষেত্রে, প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে রাষ্ট্র পরিচালনা কঠিন হয়ে যাবে। গতকাল রবিবার সংসদ ভবনে এলডি হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে দ্বিতীয় দিনের আলোচনায় বিএনপির পক্ষ থেকে এই অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে। আলোচনায় বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ক্ষমতার ভারসাম্যের জন্য তারা রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধির পক্ষে। এজন্য সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদের পর আরেকটি অনুচ্ছেদ যুক্ত করা হতে পারে পরবর্তী সংসদে আলোচনার মাধ্যমে। রাষ্ট্রপতি সংসদের উভয়কক্ষের সদস্যদের ভোটেই নির্বাচিত হবেন। সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ‘ইলেক্টোরাল কলেজে’র মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে একমত নয় বিএনপি। কোনো ব্যক্তি দুই বারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না, সংস্কার প্রক্রিয়ায় এ প্রস্তাবেও সম্মত নয় বিএনপি। দলটি মনে করছে, টানা দুই বারের বেশি না পারলেও বিরতি দিয়ে কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে চাইলে, সে সুযোগ থাকতে হবে। এটা সংকুচিত করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে গতকালের আলোচনায় বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়, তারা সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর আগের অবস্থায় ফিরে যেতে চান। কারণ সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও বহুত্ববাদ নেই। এছাড়া, রাষ্ট্রের সাংবিধানিক নাম পরিবর্তনেও সায় দেয়নি বিএনপি। আলোচনায় বিএনপির পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধিদল অংশ নেয়। প্রতিনিধিদলে ছিলেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, সালাহউদ্দিন আহমদ, বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ইসমাঈল জবিউল্লাহ, আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল ও সাবেক সচিব মনিরুজ্জামান খান। বৈঠকে ঐকমত্য কমিশনের পক্ষে নেতৃত্ব দেন এর সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। কমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন ও ড. ইফতেখারুজ্জামান এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। আলোচনার মাঝখানে বিরতিতে বিএনপির সালাহউদ্দিন আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, জনগণ যদি কোনো ব্যক্তিকে দুই মেয়াদের পর বিরতি দিয়ে আবার প্রধানমন্ত্রী করতে চায়, সেই সুযোগ সংকুচিত করা উচিত হবে না। এ ব্যাপারে বিএনপির অবস্থান স্পষ্ট। তিনি বলেন, সংস্কার কমিশনের মৌলিক অধিকারের পরিসর বৃদ্ধির বিষয়ে আমরা ভিন্ন মতামত দিয়েছি। বিএনপির অবস্থান হলো- মৌলিক অধিকার রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হয়। এটার পরিধি বাড়ালে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ব্যয় বাড়বে। তাই আমরা অনেক বিষয় অন্তর্ভুক্ত না করে রাষ্ট্র যেটুকু বহন করতে পারবে, সেটুকুই নির্ধারণের পক্ষে জোর দিয়েছি। সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন ৫০ থেকে ১০০-তে উন্নীত করার বিষয়ে বিএনপি একমত। কিন্তু এখন যেমন আছে সেটা আগামী সংসদ পর্যন্ত বহাল থাকতে হবে। আগামী সংসদ গঠিত হওয়ার পর তাদের (নারীদের) কোন পদ্ধতিতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে, তা নিয়ে আলোচনা করা হবে। অর্থাৎ ত্রয়োদশ সংসদে কীভাবে নারীরা সংসদে প্রতিনিধিত্ব করবেন তা সংসদে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পক্ষে বিএনপি। বিএনপির এই নেতা বলেন, সংবিধানের মূলনীতিতে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচার নিয়ে একমত বিএনপি। ইন্টারনেটকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিতেও আমরা একমত। এ সময় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপে বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, বিএনপির পক্ষ থেকে আলোচনা অব্যাহত আছে। আমরা কমিশনকে আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করতে চাই। কিছু বিষয়ে আমাদের আলোচনা কাছাকাছি এসেছে। গণতন্ত্রে এমনটাই হয়ে থাকে। বিএনপি বাকশালে বিশ্বাস করে না। বিএনপি (একদল) যা বলবে তাই মানতে হবে এমনটা নয়। ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে সর্বোত্তম কিছুই হবে বলে আশা রাখি। ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠক শেষে বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীর বয়স ২১ নিয়ে এখনো ঐকমত্য হয়নি। সরকারপ্রধান, সংসদনেতা ও পার্টিপ্রধান পদে একই ব্যক্তি থাকতে পারবেন না এমন বিষয়ে দ্বিমত দিয়েছে বিএনপি। কারণ, এই সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক দলের কাছে থাকাই অধিকতর গণতন্ত্রের চর্চা মনে করে বিএনপি। তিনি বলেন, লিডার অব দ্য হাউজ কে হবেন তা রাজনৈতিক দলগুলো সিদ্ধান্ত নেবে। এ বিষয়ে কমিশনের সঙ্গে দ্বিমত রয়েছে আমাদের। উচ্চকক্ষ ও নি¤œকক্ষ সদস্য সংখ্যা নিয়ে একমত বিএনপি, কিন্তু কোন প্রক্রিয়ায় তারা নির্বাচিত হবেন তা নিয়ে আলোচনা চলমান আছে। সালাহউদ্দিন বলেন, কেয়ারটেকার ছাড়া নির্বাচন ফ্রি ফেয়ার হয় না, ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’র জন্যই দেশে নির্বাচন ব্যবস্থার সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি না হওয়া পর্যন্ত কেয়ারটেকার রাখা প্রয়োজন। টানা দুই মেয়াদে কেউ প্রধানমন্ত্রীর পদে দায়িত্বপালন করে এক বার বিরতি দিয়ে আবারও দায়িত্বে আসতে পারবেন এমন প্রস্তাব দেওয়ার ব্যাখ্যায় সালাহউদ্দিন বলেন, আমাদের প্রস্তাব ‘নট মোর টু কনজিকিউটিভ টার্ম’ অর্থাৎ পরপর দুই বারের বেশি কেউ থাকতে পারবেন না; তার মানে দাঁড়াচ্ছে যদি দুই বারের পর এক বার বিরতি হয়—পরবর্তী সময়ে যদি জনগণ নির্বাচন করে সেই পার্টিকে মেজরিটি পার্টি হিসেবে, সেই পার্টি যদি সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে সেই একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন। কিন্তু, কথা হচ্ছে কেন ধরে নিচ্ছেন, একই লিডার বা একই ব্যক্তি বারবার হবেন। আমরা তো এখানে সুযোগটা রাখতে চাই। একই ব্যক্তি সরকারপ্রধান, দলেরপ্রধান ও সংসদনেতা হতে পারবেন না ঐকমত্য কমিশনের এই প্রস্তাবে বিএনপির একমত না হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা বিষয়টি উন্মুক্ত রাখতে প্রস্তাব দিয়েছি। তিনি বলেন, একই ব্যক্তি সরকারপ্রধান ও দলীয়প্রধান হতে পারবেন না—এমন চর্চা আমরা দেখি না। যুক্তরাজ্যেও আমরা দেখি, পার্টিপ্রধানকে সরকারপ্রধান করা হয়। এটি গণতান্ত্রিক চর্চা। যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রচলন হয় এবং নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রচলন করা যায়, তাহলে সেই ভোটে যারা ক্ষমতায় আসবে, মনে করতে হবে জনগণ তাদের সেই ক্ষমতা দিয়েছে। উল্লেখ্য, আগামীকাল মঙ্গলবার আবারও ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় বসবে বিএনপি।
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.