চৈত্রের খরতাপে পুড়ছে দেশ : সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায় ৩৯ ডিগ্রি
বয়ে যাওয়া মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকার পূর্বাভাস
পানিশূন্যতা পূরণে তরল খাবার বেশি খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা
স্টাফ রিপোর্টার: চৈত্রের শেষের দিকে এসে তেঁতে উঠেছে প্রকৃতি। থার্মোমিটারের পারদ উঠেছে ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। যা চলতি মরসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকা এই তাপপ্রবাহের কারণে পুড়ছে দেশ। এছাড়া রাজশাহীতে থার্মোমিটারের পারদ উঠেছে ৩৮ দশমিক ১ ডিগ্রিতে, যশোরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৩৭ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বর্তমানে দেশের ৬ জেলার ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। চলতি সপ্তাহে বৃষ্টিরও কোনো আভাস পায়নি আবহাওয়া অধিদপ্তর। এদিকে, রোজার মাসে চলমান তাপদাহে সাবধানী হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। সেহেরি ও ইফতারে লবণমিশ্রিত পানি বা স্যালাইন খেতে বলছেন। তারা বলছেন, এই গরমে অনেক ধরনের মৌসুমী স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিতে পারে। সবাইকে রোদ এড়িয়ে সাবধানে চলা উচিত। ঈদের কেনাকাটায় শিশুদেরকে সঙ্গে না নিতেও পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, গ্রীষ্মের আগে তাপদাহ যেমন বেড়েছে, তেমনই আদ্রতাও বেড়েছে। গতকাল রোববার দেশের পাঁচ বিভাগ ও এক জেলার ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের আবহাওয়া অফিস ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসকে মৃদু তাপপ্রবাহ, ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসকে মাঝারি তাপপ্রবাহ এবং তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে উঠে গেলে তাকে তীব্র তাপপ্রবাহ বলে।
আবহাওয়াবিদ মো. ওমর ফারুক বলেন, ‘এখন যে মরসুম-তাতে গরম বেশি অনুভূত হবে এটা স্বাভাবিক, তবে মাঝে মাঝে বৃষ্টি হওয়ার কথা। কালবৈশাখী যেটাকে বলে’। ‘সেটা হচ্ছে না, কারণ দক্ষিনা বাতাস নেই। কিন্তু চলতি সপ্তাহে এর কোনো সম্ভাবনা নেই। ফলে এই বাড়তি যে তাপমাত্রা, সেটা অব্যাহত থাকবে এবং সামনে বাড়তে থাকবে।’
আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশিদ জানিয়েছেন, তাপপ্রবাহের মধ্যেই কোনো কোনো স্থানে হালকা বৃষ্টিপাতও হয়েছে। সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে চাঁদপুরে ১২ মিলিমিটার। তবে এই অবস্থার মধ্যেই তাপপ্রবাহ আরও দুদিন অব্যাহত থাকতে পারে। এছাড়া বর্ধিত পাঁচদিনেও আবহাওয়ার উল্লেখ্যযোগ্য কোনো পরিবর্তনের আভাস নেই। গরমে গত কয়েকদিন ধরেই নাভিশ্বাস অবস্থা মানুষের। একদিকে রোজায় শরীর শুষ্ক, অন্যদিকে ঈদের কেনাকাটা ও রাজপথের জ্যাম মিলে বাতাসের উত্তাপ যেন আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে কষ্টকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদফতর জানায়, লঘুচাপের বর্ধিতাংশ পশ্চিমবঙ্গ ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছে। মরসুমের স্বাভাবিক লঘুচাপ দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে। আগামী ২৪ ঘণ্টার পূর্বাভাসে বলা হয়, অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ সারাদেশের আবহাওয়া শুষ্ক থাকতে পারে। ঢাকা, খুলনা ও বরিশাল বিভাগসহ রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, মৌলভীবাজার, চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলাগুলোর ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে। সারাদেশে দিন এবং রাতের তাপমাত্রা সামান্য বাড়তে পারে। আগামী ৭/৮ দিন বৃষ্টির কোনও সম্ভাবনা নেই জানিয়ে আবহাওয়াবিদ হাফিজুর রহমান বলেন, ফলে এই গরম অব্যাহত থাকতে পারে আগামী সাত দিন। এছাড়া ঋতু পরিবর্তনের এই সময় ছিটেফোঁটা বৃষ্টি বিশেষ করে সিলেটের দিকে কিছুটা হলেও কমবে না তাপমাত্রা।
এদিকে, টানা আট দিন দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বিরাজ করছে চুয়াডাঙ্গায়। এতে জেলার জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। মাঝারি তাপদাহে খেটে খাওয়া রোজাদাররা সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন। রোববার সন্ধ্যা ৬টার দিকে চুয়াডাঙ্গায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। জেলার ওপর দিয়ে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। এমন অবস্থা আরও কিছুদিন অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের জ্যেষ্ঠ পর্যবেক্ষক রাকিবুল হাসান। তিনি বলেন, জেলায় টানা কয়েক দিন দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। বর্তমানে মাঝারি তাপপ্রবাহ অব্যাহত রয়েছে। প্রতিদিনই বাড়ছে তাপমাত্রা। প্রতিদিন সর্বোচ্চ তাপমাত্রার নতুন রেকর্ড হচ্ছে। তাপপ্রবাহ আরও কয়েক দিন অব্যাহত থাকবে। চলমান তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি ছাড়িয়ে যেতে পারে। দিনের ও রাতের তাপমাত্রা প্রায় একই থাকছে।
এদিকে তীব্র গরম ও রোদের তাপের কারণে শ্রমিক, দিনমজুর, ভ্যান-রিকশা চালকরা গরমে অস্থির হয়ে পড়েন। একটু প্রশান্তির খোঁজে গাছের ছায়া ও ঠান্ডা পরিবেশে গা এলিয়ে দেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তা ঘাটে লোকজনের চলাচল সীমিত হয়ে পড়ে। আবার অনেকে জরুরি প্রয়োজন ও জীবন-জীবিকার তাগিদে প্রচ- তাপদাহ উপেক্ষা করে কাজে বের হচ্ছেন। অনেক পথচারী ছাতা মাথায় দিয়ে চলাচল করছেন। এছাড়া গরমে সদর হাসপাতালে রোগী ও স্বজনদের হাঁসফাঁস অবস্থা। প্রত্যেক ওয়ার্ডের বেশির ভাগ ফ্যান আস্তে ঘোরার কারণে অনেকে হাত পাখা কিংবা টেবিল ফ্যান নিয়ে এসেছেন। শহরের রিকশাচালক আসলাম উদ্দিন বলেন, রিকসা চালালেও আল্লাহপাক সবকটি রোজা রাখার তৌফিক দিয়েছেন। রোজার শুরুতে কিছু মনে না হলেও ৭/৮ দিন খুব কষ্ট হচ্ছে রিকশা চালাতে। দুপুর হলেই ক্লান্তিতে রিকশার প্যাডেল আর চলছে না। বিকেলের আগেই বাড়িতে ফিরে যেতে হচ্ছে। এমন গরম পড়লে রোজা রেখে রিকশা চালানো কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে। চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার বাগানপাড়ার রমেন কুমার দাস বলেন, ‘এ বছর তাপমাত্রা অনেক বেশি। গরমে বাইরে চলাচল কঠিন হয়ে পড়ছে। তাপের কারণে শরীরের চামড়া পুড়ে যাওয়ার অবস্থা। বৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে না।’ চুয়াডাঙ্গার হোগলডাঙ্গা গ্রামের রসুল মিয়া বলেন, ‘রমজান মাসে গরমে খুব কষ্ট হচ্ছে। সূর্যের তাপ অনেক। চলাফেরায় খুব কষ্ট হচ্ছে।’ আলমডাঙ্গা উপজেলার খুদিয়াখালি গ্রামের কৃষক সাইফুল ইসলাম বলেন, এখন ভুট্টা কাটার সময়। তিনদিন যাবত নিজের ভুট্টা ক্ষেতে ভুট্টা কাটছি। প্রচ- রোদের কারণে গরমে আজ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছি। অনেক রোজাদার কৃষক মাঠে কাজ করছেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মাঠে কাজ করায় দুষ্কার হয়ে পড়েছে তাদের। নির্ধারিত সময়ের আগেই বাড়ি চলে যাচ্ছেন।
চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে আব্দুল জব্বার নামে এক রোগীর স্বজন বলেন, তিনদিন আগে হৃদরোগে আক্রাক্ত হলে আমার বড় বোনকে মেডিসিন ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। প্রচ- গরমে সেখানে ফ্যানের বাতাস গায়েই লাগছে না। বাধ্য হয়ে হাত পাখা কিনেছি। আবার কেউ কেউ টেবিল ফ্যান নিয়ে এসেছেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক পংকজ কান্তি দত্ত বলেন, “গরমের সমস্যা বহুমুখী। যারা বাইরে শ্রমজীবী, তারা অতিরিক্ত ঘাম হয়ে পানিশূন্যতায় ভুগবেন। একপর্যায়ে ঘাম বন্ধ হয়ে হিট স্ট্রোক হতে পারে। আবার এই গরমে পানিশূন্যতা কাটাতে রাস্তার ধারের অনেক জায়গা থেকে শরবত, আখের রস ইত্যাদি খান। এতে পানিবাহিত নানা রোগ হতে পারে। ‘সবাইকে বেশি বেশি স্যালাইন বা লবণসমৃদ্ধ পানি খেতে হবে। শুধু পানি খেলেও পানিশূন্যতা পুরো কমবে না; কারণ, লবণের ঘাটতি হবে। পানিশূন্যতা পূরণে তরল খাবার খাবেন, তবে দেখতে হবে সেটা নিরাপদ কি না।’