চুয়াডাঙ্গায় আভ্যন্তরীণ কোন্দলে থমকে যাচ্ছে তৃণমূলের রাজনীতি
মেয়াদোত্তীর্ণ-বিলুপ্ত কমিটি দিয়ে চলছে আ.লীগ ও সহযোগী সংগঠনের কার্যক্রম
স্টাফ রিপোর্টার: চুয়াডাঙ্গায় মেয়াদোত্তীর্ণ-বিলুপ্তি কমিটি দিয়েই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের কার্যক্রম চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। প্রায় তিন বছর আগেই চুয়াডাঙ্গা জেলা আওয়ামী লীগের ৭১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটির মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে। যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ অন্য সংগঠনগুলোর একই অবস্থা। ইতোমধ্যে তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে ক্ষমতাসীন এ সংগঠনটির নেতা-কর্মীরা। বিভক্তির কারণে অনেক নেতাকর্মী দিকভ্রষ্ট হয়ে পড়ছেন। সাংগঠনিকভাবে পিছিয়ে পড়ছে তৃণমূলের রাজনীতিও। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকও দলের এ দুরবস্থার কথা অকপটে স্বীকার করেন।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, এক যুগ পর ২০১৫ সালের ২ ডিসেম্বর জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনের প্রায় সাড়ে ৪ মাস পর ৭১ সদস্য বিশিষ্ট জেলা আওয়ামী লীগের কমিটি অনুমোদন দেন দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা। ৩৪ মাস আগেই (২০১৬-২০১৯) তিনবছর মেয়াদি কমিটির মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে। গত ১২ নভেম্বর জেলা আওয়ামী লীগের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলন হওয়ার কথা ছিলো। এ ব্যাপারে জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আসাদুল হক বিশ্বাস জানান, অদৃশ্য কারণে ঘোষিত তারিখের সম্মেলনও পিছিয়ে গেছে। কবে হবে তারও কোনো ঠিক নেই। আগামী ২৭ নভেম্বর এ সম্মেলন হওয়ার কথা অনেকেই বলছেন।
একযুগ পর ওবাইদুর রহমান চৌধুরী জিপুকে আহ্বায়ক করে ২০১৫ সালের ১২ সেপ্টেম্বর জেলা যুবলীগের ২১ সদস্য বিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটির অনুমোদন দেয় কেন্দ্রীয় যুবলীগ। যুবলীগের আভ্যন্তরীণ কোন্দলে ২০১৫ সালের ১৬ নভেম্বর চুয়াডাঙ্গার ডিঙ্গেদহ এলাকার যুবলীগ কর্মী আজিজুল ইসলাম খুন হন। এরপর দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে কর্মী খুনের পরদিনই যুবলীগের কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় যুবলীগ। বিলুপ্তির পর প্রায় ২৬ মাস জেলা যুবলীগ নেতৃত্ব শূন্য থাকে। এরপর নঈম হাসান জোয়ার্দ্দারকে আহ্বায়ক করে ২০১৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি আবারও ২১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটির অনুমোদন দেয় কেন্দ্রীয় যুবলীগ। ৯০ দিনের এই কমিটি প্রায় ৫ বছরেও পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে রূপ দিতে না পারায় হতাশ যুবলীগ নেতাকর্মীরা। কেন্দ্রীয় যুবলীগ নেতাদের ওপর দায় চাপিয়ে জেলা যুবলীগ আহ্বায়ক নঈম হাসান জোয়ার্দ্দার বলেন, কেন্দ্র থেকে সময় না পাওয়ায় সম্মেলন করা সম্ভব হচ্ছে না। কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ সময় দিলেই সম্মেলন করা হবে।
কেন্দ্রীয় যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও খুলনা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা সুব্রত পাল বলেন, বিভিন্ন কারণে বেশ কয়েকটি জেলায় সম্মেলন করা সম্ভব হয়নি। আগামী ডিসেম্বর অথবা জানুয়ারিতে চুয়াডাঙ্গা জেলা যুবলীগের সম্মেলন করার ইচ্ছে আছে।
এরপর ২০১৭ সালের ২ জুন মোহাইমেন হাসান জোয়ার্দ্দার অনিককে সভাপতি ও মো. জানিফকে সাধারণ সম্পাদক করে চুয়াডাঙ্গা জেলা ছাত্রলীগের ৪ সদস্যের কমিটির অনুমোদন দেয় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দুই মেরুর হওয়ায় এই কমিটি ৪ বছর ৭ মাসেও পূর্ণতা পায় না। মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ায় ২০২১ সালের ১৯ ডিসেম্বর বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয় ছাত্রলীগের ওই কমিটি। সেই সাথে ছাত্রলীগের কমিটি গঠনের লক্ষ্যে ৭ কার্য দিবসের মধ্যে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি কামাল খান, উপ-সমাজসেবা সম্পাদক হাসানুর রহমান হাসু ও উপ-মুক্তিযুদ্ধ ও গবেষণা সম্পাদক আরিফ হোসেনের কাছে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক পদে আগ্রহীদের জীবন বৃত্তান্ত জমা দেয়ার কথা বলা হয়। কেন্দ্রীয় কমিটির নির্দেশনা মোতাবেক সভাপতি পদে ১৭জন ও সাধারণ সম্পাদক পদে ৭৮ জন পদপ্রত্যাশী ছাত্রনেতা তাদের জীবন বৃত্তান্ত জমা দেন। এরপরও কমিটি আলোর মুখ দেখেনি। ফলে ছাত্র সংগঠনটি বর্তমানে অভিভাবকহীন। পদ-প্রত্যাশী ছাত্র নেতারা নতুন নেতৃত্বের সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। ছাত্রলীগের কার্যক্রমও স্থবির হয়ে পড়েছে। সভাপতি পদ প্রত্যাশী ছাত্রলীগ নেতা জাকির হুসাইন জ্যাকি জানান, কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের কাছে ৯৫ জন আবেদন করেছি। কেন্দ্রীয় কমিটি অনুমোদন দেয়নি। তিনি আরও বলেন, ১৩ বছর ধরে জেলায় ছাত্রলীগের উপজেলা, পৌর ও ওয়ার্ড পর্যায়ে কোনো কমিটি নেই। তাই আমরা সাংগঠনিকভাবেও পিছিয়ে পড়ছি। দ্রুতই আমরা চুয়াডাঙ্গা জেলা ছাত্রলীগের কমিটি প্রত্যাশা করছি।
কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের উপ-সমাজসেবা সম্পাদক হাসানুর রহমান হাসু জানান, আমাদের দায়িত্ব ছিলো চুয়াডাঙ্গা ছাত্রলীগের পদ-প্রত্যাশীদের জীবনবৃত্তান্ত সংগ্রহ করা। আমরা নির্দিষ্ট সময়ে ৯৫ জনের তালিকা হস্তান্তর করেছি। কিন্তু কেন কমিটি হচ্ছে না তা কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকই বলতে পারবেন।
দলের ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাকর্মীরা ছাত্রলীগের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে এবং তৃণমূল নেতাকর্মীদের ছাত্র রাজনীতিকে উৎসাহিত করতে চুয়াডাঙ্গা জেলা ছাত্রলীগের কমিটিসহ থানা, উপজেলা ও কলেজ শাখা ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের জোর দাবি জানিয়েছেন। স্থানীয় রাজনীতি প্রকাশ্যে বিরোধ এখনও বিরাজমান থাকায় ছাত্রলীগের কমিটি গঠন প্রক্রিয়াটি থমকে আছে বলেও অনেকে মনে করেন।
২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত চুয়াডাঙ্গা পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন ওবায়দুর রহমান চৌধুরী জিপু। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে পরাজিত করে জয়লাভও করেন তিনি। দল থেকে বিচ্ছিন্ন এই নেতা ওই সময় দলীয় পদ পেতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। যোগাযোগ করতে থাকেন কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে। অবশেষে ২০১৮ সালের জুলাই মাসে স্বেচ্ছাসেবক লীগের আহ্বায়ক নির্বাচিত হন ওবায়দুর রহমান চৌধুরী জিপু। চার বছর ৩ মাস পার হলেও কোনো সম্মেলন করতে পারেনি স্বেচ্ছাসেবক লীগের আহ্বায়ক কমিটি। মেয়াদ উত্তীর্ণ স্বেচ্ছাসেবক লীগের এই আহ্বায়ক বর্তমানে মেয়াদোত্তীর্ণ জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটিরও ১নং সদস্য পদে বিদ্যমান।
দলীয় কোন্দলের বিষয়টি স্বীকার করে জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের আহ্বায়ক ওবায়দুর রহমান চৌধুরী জিপু বলেন, ৯০ দিনের মধ্যে কমিটি করার কথা থাকলেও আমি তা করতে পারিনি। করোনার কারণে আমরা দুই বছর পিছিয়ে গেছি। ইতোমধ্যে চুয়াডাঙ্গার চারটি উপজেলা কমিটি ও চারটি পৌরসভা কমিটিসহ ওয়ার্ড কমিটিগুলোও গঠন করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে একাধিকবার জেলা সম্মেলন করার জন্য নির্দেশনা চাইলেও তা পাওয়া যায়নি। নির্দেশনা পেলেই জেলা সম্মেলনের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হবে।
জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের কমিটিও রয়েছে ছন্নছাড়া অবস্থায়। দেড়যুগ পর ২০১৬ সালের জুন মাসে সম্মেলনের মাধ্যমে কহিনুর বেগমকে সভাপতি ও নুরুন্নাহার কাকলীকে সাধারণ সম্পাদক করে দুই সদস্যের কমিটি ঘোষণা করা হয়। সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার কিছুদিনের মধ্যে কহিনুর বেগম যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। ফলে এই কমিটি ৫ বছর পার করলেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি আলোর মুখ দেখাতে পারেনি। চলতি বছরের মে মাসে জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের ওই কমিটিকেও বিলুপ্ত ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় মহিলা আওয়ামী লীগ। সেই সাথে নুরুন্নাহার কাকলীকে আহ্বায়ক ও নাবিলা রোকসানা ছন্দাকে সদস্য সচিব করে ১১ সদস্য বিশিষ্ট সম্মেলন প্রস্তুত কমিটিরও অনুমোদন দেয়া হয়। চলতি বছরের ৩০ জুলাইয়ের মধ্যে সম্মেলনের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ কমিটির ঘোষণা দেয়ারও নির্দেশনা দেয় কেন্দ্রীয় মহিলা আওয়ামী লীগ। মহিলা আওয়ামী লীগের কমিটি ও সম্মেলনের বিষয়ে জানতে চাইলে সম্মেলন প্রস্তুত কমিটির আহ্বায়ক নুরুন্নাহার কাকলী বলেন, আপনারা আবার আমাদের পেছনে লাগছেন কেন? আমাদের কমিটির তালিকা নিয়ে আপনারা কী করবেন?
এছাড়া জেলা কৃষকলীগের কমিটির মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে ৩১ মাস আগেই। দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে সভাপতি গোলাম ফারুক জোয়ার্দ্দার দল থেকে বহিষ্কৃত হন। সংগঠনটি বর্তমানে চলছে সম্মেলন প্রস্তুত কমিটি দিয়ে। কমিটির সদস্য সচিব মোস্তাফিজুর রহমান মাজু বলেন, খুব দ্রুতই আমরা সম্মেলনের মাধ্যমে মূল কমিটি ঘোষণা করবো।
২০ মাস আগেই জেলা শ্রমিক লীগের জেলা কমিটিরও মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে। আগামী ডিসেম্বরের যেকোনো দিন সম্মেলন হবে বলে জানান শ্রমিক লীগ সভাপতি আফজালুুল হক বিশ্বাস।
দেড়যুগ পর চলতি বছরের মার্চে জীবননগর, দামুড়হুদা ও আলমডাঙ্গা উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে তিনটি উপজেলাতেই সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক করে দুই সদস্যের কমিটি ঘোষণা দেয়া হয়। ৩০ দিনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটির ঘোষণার কথা থাকলেও অদৃশ্য কারণে তা সম্ভব হয়নি। সর্বশেষ ১৮ বছর পর গত ৩০ অক্টোবর চুয়াডাঙ্গা সদর ও পৌর আ.লীগের দুই সদস্য করে কমিটি ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
জীবননগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল লতিফ অমল বলেন, পূর্ণাঙ্গ কমিটি প্রস্তুত করা হয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে তা অনুমোদন করা সম্ভব হয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, ‘জেলা আওয়ামী লীগসহ সহযোগী সংগঠনগুলোর কমিটি বিলুপ্ত ও মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার একমাত্র কারণ আভ্যন্তরীণ কোন্দল। চুয়াডাঙ্গা জেলা আওয়ামী লীগ বর্তমানে তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে।’
দলের আভ্যন্তরীণ কোন্দলের বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আজাদুল ইসলাম আজাদ বলেন, ‘নেতৃত্বের প্রতিযোগিতার কারণে আভ্যন্তরীণ কোন্দল আছে। দলের সহযোগী সংগঠনগুলো বিলুপ্ত ও মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে। যার কারণে সাংগঠনিকভাবে পিছিয়ে পড়ছে তৃণমূলের রাজনীতিও। নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টির সম্ভাবনাও হারিয়ে ফেলছে দলটি।’