চরমপন্থি সংগঠনের বিরোধ নাকি বাঁওড় দখল : মিলছে না সূত্র

শৈলকুপায় ট্রিপল মার্ডারের দিন পর থানায় মামলা : আসামি অজ্ঞাত

স্টাফ রিপোর্টার: ঝিনাইদহের শৈলকুপায় পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির (জনযুদ্ধ) সামরিক কমান্ডারসহ তিনজনকে গুলি করে হত্যার তিন দিন পর থানায় মামলা হয়েছে। গতকাল সোমবার মামলাটি করেন নিহত হানিফের ছোট ভাই হরিণাকু-ু উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান সাজেদুল ইসলাম এশা। গত শুক্রবার রাতে শৈলকুপা উপজেলার ত্রিবেণী ইউনিয়নের রামচন্দ্রপুর গ্রামের শ্মশান ঘাটে তিনজনকে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। পরে রাতেই স্থানীয় সাংবাদিকদের হোয়াটসআপ গ্রুপে বার্তা পাঠিয়ে কুষ্টিয়া এলাকার চরমপন্থি সংগঠন জাসদ গণবাহিনীর নেতা কালু দ্বায় স্বীকার করেন। একই সঙ্গে তিনি নিহত হানিফের অন্য অনুসারীরা সংশোধন না হলে তাদের পরিণতিও একই হবে বলে হুঁশিয়ারি দেন। ২০১৫ সালে একই শ্মশান ঘাটে গণবাহিনীর পাঁচ কর্মীকে গুলি করে ও গলা কেটে হত্যা করে প্রতিপক্ষ। ধারণা করা হচ্ছে, এরই প্রতিশোধ নিতে শুক্রবার রাতে ঝিনাইদহের হরিণাকু-ুর আহাদনগর গ্রামের রাহাজ উদ্দিনের ছেলে পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি জনযুদ্ধের (লাল পতাকা) সামরিক কমান্ডার হানিফ আলী (৫৬), তার শ্যালক একই উপজেলার শ্রীরামপুর গ্রামের উন্মাদ আলীর ছেলে লিটন হোসেন (৩৮) ও কুষ্টিয়া ইবি থানার পিয়ারপুর গ্রামের আরজান হোসেনের ছেলে রাইসুল ইসলাম রাজুকে (২৮) হত্যা করা হয়। রাজুর লাশ ধানক্ষেতে পানির মধ্যে পড়ে ছিলো। হানিফ ও লিটনের লাশের পাশ থেকে পুলিশ দুটি পালসার মোটরসাইকেল ও দুটি হেলমেট জব্দ করে। তিনজনেরই মাথা ও বুকে গুলির চিহ্ন রয়েছে। ঘটনাস্থলে শটগানের সাত ও পিস্তলের ছয় রাউন্ড গুলি পাওয়া যায়। শুধু শটগানের চার রাউন্ড গুলি বিস্ফোরিত ছিলো।
হানিফ নব্বই দশকে ঝিনাইদহ, হরিণাকু-ু, চুয়াডাঙ্গা ও আলমডাঙ্গাসহ বিভিন্ন এলাকার ত্রাস ছিলেন। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় ১৪টি হত্যাসহ অসংখ্য মামলা রয়েছে। হরিণাকু-ুর কুলবাড়িয়ার আব্দুর রহমান হত্যা মামলায় আদালত হানিফের মৃত্যুদ- দেন। পরে রাষ্ট্রপতির সাধারণ ক্ষমায় মুক্তি পান। পতিত আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। কেউই তাদের বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস করেনি। ২০১৪ সালে জেল থেকে বের হন হানিফ। ২০১৭ সালে রামদিয়া-কায়েতপাড়া বাঁওড়ের মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি জিয়াউল হককে গুলি করে হত্যা করেন তিনি। এরপর থেকে বাঁওড় দখলে রেখে মাছ চাষ করে আসছিলেন। হানিফ নিজে হরিণাকু-ু উপজেলা মৎস্যজীবী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি ছিলেন। তার এক ভাই উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি; আরেক ভাই উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি।
স্থানীয় সূত্র জানায়, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলে বাঁওড় দখলে আরও কয়েকটি চরমপন্থি সংগঠন তৎপর হয়ে ওঠে। এ নিয়ে হানিফের সঙ্গে তাদের বিরোধ চরমে পৌঁছে। এরই জেরে জাসদ গণবাহিনী তাদের হত্যা করে থাকতে পারে। নিহতদের স্বজন বলছেন, হত্যাকা-ের আগে তিনজনকেই মোবাইলে কল করে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যায়। তবে কারা কল দিয়েছিলো, তা জানাতে পারেননি। পুলিশও এ হত্যাকা-ের কোনো সূত্র পাচ্ছে না।
শনিবার শৈলকুপা থানায় আসা নিহতের স্বজন জানান, হানিফের সঙ্গে সম্প্রতি রামদিয়া বাঁওড়ের দখল নিয়ে পার্শ্ববর্তী আলমডাঙ্গা উপজেলার তিয়রবিলা গ্রামের স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীর বিরোধ তৈরি হয়। প্রায়ই তারা বাঁওড়ের মাছ ধরে নিয়ে যেতেন বলে অভিযাগ রয়েছে।
হানিফের ছোট ভাই সাজেদুল ইসলাম ইশা বলেন, ‘শুক্রবার বিকেলে ভাইয়ের মোবাইলে একটি কল আসে। এরপর কিছু না বলে তিনি বাড়ি থেকে বের হন। পরে রাতে আমরা তার মৃত্যুর খবর পাই। বাঁওড়ের মাছ ধরা নিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে ভাইয়ের বিরোধ চলছিল। এরই জেরে হত্যাকা- হতে পারে।’
নিহত রাজুর মামা লিটন হোসেন জানান, রাজু শুক্রবার বিকেল ৫টার দিকে বাড়ি থেকে বের হন। এরপর রাতে তারা সংবাদ পান তাকে হত্যা করা হয়েছে। রাজু এলাকায় কোনো সন্ত্রাসী কর্মকা-ে জড়িত ছিলো না বলে দাবি করেন তিনি।
রামচন্দ্রপুর গ্রামের বাসিন্দা মাসুদ রানা জানান, শুক্রবার রাত ৮টার দিকে তারা পরপর চারটি গুলির শব্দ শুনতে পান। এলাকাবাসী চেষ্টা করেও কিছু উদ্ধার করতে পারেননি। পরে রাত ১০টার দিকে পুলিশ এলে শ্মশান ঘাটে গুলিবিদ্ধ তিনটি লাশ পায়।
শৈলকুপা থানার ওসি মাসুম খান জানান, ট্রিপল মার্ডারের ঘটনায় থানায় একটি মামলা হয়েছে। মামলার এজাহারে কোনো আসামির নাম উল্লেখ করা হয়নি। মামলায় অজ্ঞাতনামা ১৫-২০ জনকে আসামি করা হয়েছে। ওসি মাসুম খান বলেন, ঘটনার পরদিন শনিবার বিকেলে ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালের মর্গে তিনজনের ময়নাতদন্ত হয়। এরপর সন্ধ্যার দিকে মরদেহ তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কাউকে আটক বা গ্রেফতার করা যায়নি।
উল্লেখ্য, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা চুয়াডাঙ্গা ও ঝিনাইদহ। স্বাধীনতার পরবর্তী বিভিন্ন চরমপন্থি সংগঠনের অভয়ারণ্য বলা হয় এ দুটি জেলাকে। এক সময়ের সর্বহারা, পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টি, জাসদ গণবাহিনী, লাল পতাকা বাহিনী, এমএলসহ আরও বেশ কয়েকটি চরমপন্থি সংগঠনের ব্যাপক দৌরাত্ম্য চলে নব্বুইয়ের দশকের শেষ দিক পর্যন্ত। ২০০০ সালের পর থেকে তাদের অস্তিত্ব বিভিন্ন রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে এদের ব্যাপকতা কমতে থাকে। হঠাৎ গত শুক্রবারের ট্রিপল মার্ডারে এদের অস্তিত্ব নতুন করে জানান দেয়। সেখানে একটি হোয়্যাটসঅ্যাপে ক্ষুদে বার্তা ঘটনার প্রেক্ষাপট বদলে দেয়।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More