স্টাফ রিপোর্টার: ভোটের মাঠে নির্বাচন কমিশন একা সমান সুযোগ তৈরি করতে পারে না বলে মন্তব্য করেছেন নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। তিনি বলেছেন, ‘নির্বাচন কমিশনের শক্তি অসীম নয়। এটা সব সময় আপেক্ষিক। রাজনৈতিক দলগুলো যদি নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করতে না পারে তবে আমরা মুরুব্বি হতে পারব না।’ এ ছাড়া দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে দেশের রাজনৈতিক নেতাদের নিজেদের মধ্যে ‘সমঝোতা’য় আসার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
শপথ নেয়ার পরদিন গতকাল আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে দায়িত্ব গ্রহণ করেন নতুন নির্বাচন কমিশনের সদস্যরা। পরে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন সিইসি হাবিবুল আউয়াল। এ সময় উপস্থিত ছিলেন নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আহসান হাবিব খান, রাশিদা সুলতানা, মো. আলমগীর, আনিছুর রহমান এবং ইসি সচিব হুমায়ুন কবীর খোন্দকার। সিইসি বলেছেন, ‘আমরা অনুনয়-বিনয় করব, আপনারা নিজেদের মধ্যে সমঝোতা সৃষ্টি করুন। একটা চুক্তিবদ্ধ হন যে নির্বাচনটা সুন্দরভাবে পরিচালনা করবেন। ওখানে সহিংসতা থাকবে না। কেউ কাউকে বাধা দেবে না।’ তিনি বলেন, ‘আমরা প্রত্যাশা করি সবাই নির্বাচনে অংশ নিয়ে গণতন্ত্র সুসংহত করবেন। যারা নির্বাচন করবেন তাদের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করার দায়িত্ব কমিশনের রয়েছে। কর্মপদ্ধতি কী হবে তা ঠিক করিনি।’ নির্বাচনকে একটি ‘বিশাল কর্মযজ্ঞ’ হিসেবে বর্ণনা করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দলের আগ্রহ থাকে, সবার আবেগ বুঝতে হয়। আমরা সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে নির্বাচন বিষয়ে দায়িত্ব পালন করব। আমরা কতটা সৎ ছিলাম, দায়িত্ব পালন করেছি, তা পরে মূল্যায়ন করতে পারবেন।’ তিনি বলেন, ‘আগের কমিশনের ব্যর্থতা-সফলতা মূল্যায়নের প্রশ্ন আসবে। কিন্তু এ মুহূর্তে আগের কমিশনের দোষ-ত্রুটি নিয়ে কিছু বলতে চাই না। তবে শিক্ষণীয় কোনো বিষয় থাকলে সে বিষয়ে আমরা কাজ করব।’ কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) নিয়ে কী সিদ্ধান্ত হবে তা এখনই বলতে পারছি না। আমরা ইভিএমের ভালো-মন্দ নিয়ে আলোচনা করব। পাশাপাশি ব্যালটের ভালো-মন্দটাও দেখব। পরে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। আমি নিজেও ইভিএম ভালো করে বুঝি না।’ তিনি বলেন, ‘আমরা নির্বাচন সংশ্লিষ্ট আইনগুলোও পর্যাপ্ত কি না তা দেখব। নির্বাচন পরিচালনায় আমরা গুরুত্ব দেব। আমরা সেনসেটাইজ করব। পর্যবেক্ষণও করব। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কমিশন একা তৈরি করতে পারে না। পলিটিক্যাল লিডারশিপ আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি মিলিয়েই কিন্তু হয়। আমরা যদি মুখ ফিরিয়ে থাকি তাহলে দূরত্ব বাড়বে। রাজনৈতিক দলগুলোর কাউকে না কাউকে অহংকার বাদ দিয়ে আলোচনায় আসতে হবে।’ সাংবাদিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘ভোট হবে ভোটের নিয়মে। আগের রাতে ভোট হতো কি না জানি না। আমি অস্ট্রেলিয়ায় বসে দিনে ভোট দিতে দেখেছি। আমি জানি তা হয় কি না। তবে আমরা সেদিকে যেতে চাই না। যদি দেখেন আমরা তা করেছি তখন বলতে পারেন। যদি মানুষের আস্থা বিনষ্ট হয় তাহলে তা ফেরানোর চেষ্টা কি আমরা করব না? আমাদের আপনারা পর্যবেক্ষণে রাখুন, আমরা তো সেখানে বাধা দেব না। ভোট কেন্দ্রে কোনো সহিংসতা বা সংঘাতে জড়াবে না- রাজনৈতিক দলগুলো এমন চুক্তিতে আসতে পারে।’ বিএনপির আস্থা অর্জনের বিষয়ে কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘বিএনপি যদি ঘোষণা দিয়েও থাকে (ভোটে না আসার বিষয়ে), তাদের কি আহ্বান জানাতে পারবো না? কোনো কিছুই শেষ নয়। আমরা তো তাদের চা খেতে আমন্ত্রণ জানাতেও পারি।’ সংবাদ সম্মেলনে সিইসি বলেন, রাজনৈতিক নেতৃত্বের যে দায়িত্বটা রয়েছে সেটা যদি শেয়ার না করেন তাহলে নির্বাচন কমিশন এককভাবে যে কাজ করবে সেখানে সীমাবদ্ধতা দেখা দেবে। আমাদের দায়িত্ব আছে রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে আবদার করা, বিনয় করা, অনুনয় করা। রাজনৈতিক নেতৃত্বকে আমরা সহযোগিতা করব। রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদি রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সহায়তা না করে, পলিটিক্যাল লিডারশিপের যদি ন্যূনতম সমঝোতা না থাকে। আমি তো তাদের মুরুব্বি হতে পারব না। উনারা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি জ্ঞানী, অনেক বেশি অভিজ্ঞ।’ দায়িত্ব নেয়ার দিনও তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলো যদি নির্বাচন অর্থবহ করার জন্য স্ব স্ব অবস্থান থেকে করণীয় না করে, উনারা নিজেদের প্রশ্ন করবেন, নাকি আমাদের প্রশ্নবিদ্ধ করবেন? তাহলে আমি সবিনয়ে বলব আমাদের ক্ষমা করবেন। আপনাদের কিছু যদি ব্যর্থতা থাকে তবে তা-ও স্বীকার করুন। সবাই যেন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা রিস্টোর করুন। একটা ভালো সংসদ উপহার দিতে চেষ্টার ত্রুটি থাকবে না।’ কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন এই নতুন ইসির অধীনেই আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। তবে সে সময় আওয়ামী লীগ যদি ক্ষমতায় থাকে সে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। এ বিষয়ে সাংবাদিকরা দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সিইসি বলেন, ‘বিএনপি যদি এমন ঘোষণা দিয়েও থাকে আমরা কি তাদের চা খাওয়ার আমন্ত্রণ জানাব না? কোনো কথাই শেষ কথাই নয়।’ তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের মধ্যে একটা সমঝোতা সৃষ্টির চেষ্টা করতে হবে। কেউ কারও সঙ্গে কথা বলব না, মাঠে যুদ্ধ করব…। আলোচনা মাধ্যমে দূরত্ব কমে আসে। আমরা যদি মুখ ফিরিয়ে থাকি তাহলে কিন্তু দূরত্ব বাড়তে থাকবে। আলোচনা করতে হবে। কাউকে না কাউকে অহংকার পরিত্যাগ করে আলোচনা করতে হবে। নির্বাচন কমিশনের শক্তি অসীম নয়। এটা সব সময় আপেক্ষিক।’ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের ভোট বর্জন প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন আর যুদ্ধের চলমান ঘটনাপ্রবাহ থেকে উদাহরণ টানেন সিইসি। তিনি বলেন, ‘মাঠ ছেড়ে চলে গেলে হবে না। মাঠে থাকবেন। কষ্ট হবে। জেলেনস্কি (ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট) পালিয়ে যেতে পারতেন। তিনি প্রতিরোধ যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। ধস্তাধস্তি হয়।’ তিনি বলেন, ‘সবাই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে একটি দ্বান্দ্বিক সংসদ গড়ে উঠুক। আমরা সুন্দর নির্বাচনের মাধ্যমে গুড গভর্ন্যান্স ও ভালো সংসদ গড়ে তোলার চেষ্টা করব। এদিক থেকে আমাদের কোনো কার্পণ্য থাকবে না।’ সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি নতুন কমিশনকে ‘আমলানির্ভর’ আখ্যা দিয়েছে, এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘আমি কি রাতে গিয়ে ভোটবাক্স চুরি করে ওখানে গিয়ে ভোট দেব নাকি দেখেও না দেখার মতো থাকব। আমি সরকারি কর্মচারী ছিলাম। অতীতে যারা ছিলেন, কে ছিলেন না?। কেউ কেউ বলেন শামসুল হুদা সাহেবের নির্বাচন ভালো ছিল, কেউ বলেন সাহাবুদ্দীন সাহেবেরটা ভালো ছিল। এগুলো আপেক্ষিক।’ আবারও রাজনৈতিক নেতাদের দায়িত্বের দিকগুলো মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক নেতৃত্বের যে দায়িত্বটা রয়েছে তা যদি শেয়ার না করেন তাহলে নির্বাচন কমিশন এককভাবে যে কাজ করবে সেখানে সীমাবদ্ধতা দেখা দেবে। ভোট কেন্দ্রে গিয়ে যারা ভোট দেন, সেটা হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আশাবাদী। আমাদের ওপর আস্থা রাখুন।’ বিএনপির নির্বাচনকালীন সরকারের দাবি নিয়ে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, ‘নির্বাচন সরকার করে না। নির্বাচনের সময় একটা সরকার থাকে। কোনো না কোনো সরকার থাকবেই। ওয়ান-ইলেভেনের সময় ছিল, নির্দলীয় সরকার ছিল। এখন যে সাংবিধানিক ব্যবস্থা আছে তা মেনেই আমরা চেষ্টা করব ভোটাররা যাতে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন, সেটা বড় চ্যালেঞ্জ।’
নতুন ইসিকে বরণ : দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের দায়িত্ব পাওয়া প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালসহ অন্য কমিশনাররা গতকাল দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। শপথ নেয়ার পর গতকাল প্রথম কর্মদিবস সকাল পৌনে ৯টার দিকে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল এসে উপস্থিত হন। এর আগে ৯টা ৪১ মিনিটে আসেন নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবীব খান। ৯টা ৫০ মিনিটে নির্বাচন কমিশনার বেগম রাশিদা সুলতানা আসেন নির্বাচন ভবনে। সকাল ১০টায় এসে উপস্থিত হন আনিছুর রহমান। ১০টা ৪ মিনিটে আসেন নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর। পরে ইসি সচিব হুমায়ূন কবীর খোন্দকারের নেতৃত্বে নতুন কমিশনকে ফুল দিয়ে বরণ করেন নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা। এরপর বেলা ১১টায় ইসির কনফারেন্স রুমে কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করেন নতুন ইসি। এদিকে ধানমন্ডিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ (সিইসি) নতুন নির্বাচন কমিশনাররা। বিকাল সোয়া ৪টায় সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বে কমিশনাররা ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানান।
সিইসি ও নির্বাচন কমিশনারদের একান্ত সচিব নিয়ে হযবরল অবস্থা : নতুন নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিনই সাবেক সিইসি কে এম নূরুল হুদা ও নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের একান্ত সচিবকে বদলি করা হয়েছে। এ ছাড়া সিইসি ও নির্বাচন কমিশনারদের একান্ত সচিব নিয়ে গতকাল দিনভর হযবরল অবস্থা ছিল নির্বাচন কমিশনে।
গতকাল সকালে নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও চার নির্বাচন কমিশনার ইসিতে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তবে দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিন একান্ত সচিব নিয়ে হযবরল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে সিইসি ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনের দফতরে। সিইসির দফতরে আসলে কে একান্ত সচিবের দায়িত্বে ছিলেন গতকাল পর্যন্ত তা-ও স্পষ্ট ছিল না। গতকাল দেখা গেছে সিইসির একান্ত সচিব এ কে এম মাজহারুল ইসলামের পাশাপাশি আরও দুই কর্মকর্তা সিইসির দফতরে দায়িত্ব পালন করছেন। যদিও বিকালে সিইসির একান্ত সচিবকে বদলি করা হয়েছে। চার নির্বাচন কমিশনারের একান্ত সচিব পদে চারজনের দায়িত্ব থাকলেও অতিরিক্ত আরও দুজনকে একান্ত সচিবের দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে।
নির্বাচন কমিশনার (১) আহসান হাবীব খানের একান্ত সচিব হিসেবে মুহাম্মদ এনাম উদ্দীন সকালে নির্বাচন ভবনে এই নির্বাচন কমিশনারকে রিসিভ করেন। তবে তিনি একান্ত সচিব হিসেবে দায়িত্বে থাকায় অবস্থায় এ দফতরে মৌখিক দায়িত্ব পালনের নির্দেশনা দেওয়া হয় নির্বাচন কমিশনার (৩)-এর একান্ত সচিব আসমা দিলারা জান্নাতকে। আর নির্বাচন কমিশনার (৩) মো. আলমগীরের দফতরে মৌখিক নির্দেশনায় দায়িত্ব দেয়া হয় রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাচন অফিসার মাহবুবুর রহমানকে। এ ছাড়া নির্বাচন কমিশনার (২) রাশিদা সুলতানার দফতরে একান্ত সচিবের দায়িত্বে রয়েছেন মো. লুৎফুল কবির সরকার। কিন্তু এ দফতরে দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে সহকারী সচিব হাবিবা আখতারকে। আবার নির্বাচন কমিশনার (২)-এর একান্ত সচিবকে মৌখিক নির্দেশনায় দায়িত্ব দেয়া হয় নির্বাচন কমিশনার (৪) মো. আনিছুর রহমানের দফতরে। যদিও এ দফতরের একান্ত সচিবের দায়িত্বে রয়েছেন মো. তকদির আহমেদ। আসলে কে কোন নির্বাচন কমিশনারের একান্ত সচিব তা নিয়ে গতকাল হযবরল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। কদিন এ অবস্থায় চলবে তা কেউ জানেন না। এ অবস্থায় দায়িত্ব পালনে অস্বস্তিতে রয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্তকর্তারা। তবে দুপুরে হঠাৎ নির্বাচন কমিশনার (১)-এর একান্ত সচিব মুহাম্মদ এনাম উদ্দীনকে বদলি করা হয়েছে। যিনি আগে সদ্যবিদায়ী নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারে একান্ত সচিব ছিলেন।