সুখবর জানাতে প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন আজ : ২০১৮ সালেই পূরণ হয়েছে তিন শর্ত
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণে জাতিসংঘের চূড়ান্ত সুপারিশ পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ
স্টাফ রিপোর্টার: স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (সিডিপি) চূড়ান্ত সুপারিশ পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। গতকাল শুক্রবার রাতে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে এক সভায় সিডিপি এ সুপারিশ করতে যাচ্ছে। এ বছর চূড়ান্ত সুপারিশ পাওয়া গেলে নিয়মানুযায়ী ২০২৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি মিলবে। সিডিপির সুপারিশ পাওয়া উপলক্ষে আজ সংবাদ সম্মেলন ডেকেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। গতকাল শুক্রবার প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম জানান, শনিবার বিকেল ৪টায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে গণভবন থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চুয়ালি যুক্ত হবেন। সরকারপ্রধান হওয়ার পর থেকে বিদেশ সফর করে বা অন্য সব ইস্যুতে মাঝে-মধ্যে গণভবনে সংবাদ সম্মেলন করে আসছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে প্রায় এক বছর পর তিনি সাংবাদিকদের মুখোমুখি (ভার্চুয়ালি) হতে যাচ্ছেন।
সূত্র জানায়, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি বড় অর্জন যুক্ত হতে যাচ্ছে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদার কাতারে শামিল হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এখন আর গরিব বা স্বল্পোন্নত দেশ নয়, বরং সেই জায়গায় উন্নয়নশীল দেশের এক নতুন মর্যাদা নিয়ে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের নাম উচ্চারিত হবে। এ অর্জন বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গৌরব ও সম্মানের। এর ফলে আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যে সাময়িক কিছু চ্যালেঞ্জ এলেও দীর্ঘমেয়াদে সুফল পাবে দেশ। মুছে যাবে গরিব দেশের তিলক।
এ প্রসঙ্গে শুক্রবার পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য সচিব (সিনিয়র) ড. শামসুল আলম বলেন, সিডিপির সুপারিশ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং মুজিব শতবর্ষে বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি যোগ করবে। জাতি হিসাবে এটি আমাদের বড় অর্জন। আমরা এখন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবো। কিছু ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ তৈরি হলেও ক্রেডিট রেটিং অনেক বেড়ে যাবে। ফলে কোনো সমস্যা হবে না। আমরা সেই সামর্থ্য ও যোগ্যতা অর্জন করে এলডিসি উত্তরণ করছি। ইতোমধ্যে আমরা মন্ত্রণালয়ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা তৈরি করেছি। এছাড়া এফটিএ, পিটিএসহ বিভিন্ন চুক্তির প্রস্তুতি চলছে। ফলে বাণিজ্য বাড়বে। এছাড়া পণ্য বৈচিত্র্যসহ রপ্তানি বাড়াতে নানা উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
সূত্র জানায়, জাতিসংঘের হিসাবে বিশ্বে তিন ধরনের দেশ রয়েছে। এগুলো হলো- উন্নত দেশ, উন্নয়নশীল দেশ এবং স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি)। মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ সূচক এবং অর্থনৈতিক সংকট সূচক অনুযায়ী জাতিসংঘ হিসাব করে থাকে। বর্তমান বিশ্বে বাংলাদেশসহ ৪৭টি দেশ এলডিসি হিসাবে রয়েছে। এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার স্বীকৃতি দিয়ে থাকে জাতিসংঘ। এ মূল্যায়ন করে সিডিপি। পুরো প্রক্রিয়াটি শেষ হতে অন্তত ছয় বছর লাগে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ প্রাথমিক যোগ্যতা অর্জন করে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো হওয়ায় এলডিসি উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ করা হচ্ছে। এটি বাংলাদেশের জন্য সুখবর। কিন্তু এলডিসি উত্তরণ পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশকে আরও বেশি কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
জানা গেছে, এলডিসি থেকে বেরিয়ে আসার পর সামগ্রিক অর্থনৈতিক কার্যক্রম গতিশীল রাখার প্রস্তুতি রয়েছে বাংলাদেশের। শুল্ক ও কোটামুক্ত বাজার সুবিধা নিশ্চিত করতে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ), মুক্তবাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) এবং বৃহৎ অংশীদারিত্ব বাণিজ্য চুক্তির (সিপা) মতো বড় বড় চুক্তির দিকে এগিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ভুটানের পর নেপালের সঙ্গে পিটিএ করা হচ্ছে। ভারতের সঙ্গে সিপা চুক্তি করা হবে। একই সঙ্গে উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে রফতানিতে জিএসপি প্লাস সুবিধা নিশ্চিত করতে চায় বাংলাদেশ। এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পরও যাতে অন্তত ১২ বছর স্বল্পোন্নত দেশ হিসাবে রপ্তানি-আমদানি বাণিজ্যে সুযোগ-সুবিধা বহাল রাখা হয় সেজন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য দফতর ইউএসটিআরে আবেদন করা হয়েছে। ডব্লিউটিওতে এ বিষয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। যুক্তরাজ্যে ২০২৭ সাল পর্যন্ত রপ্তানিতে শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধার ঘোষণায় রপ্তানিকারকরা আশাবাদী হয়ে উঠছেন। এছাড়া সরকারি সংস্থাগুলোও শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা আদায়ে কাজ করছে।
স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে আসার পর অর্থনীতিতে বেশকিছু ঝুঁকি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এক্ষেত্রে রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার বিষয়টি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। এছাড়া বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান পাওয়ার ক্ষেত্রে দাতাদের কঠিন শর্তের মুখে পড়ার ঝুঁকিও দেখা দিতে পারে। তবে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় গেলে আন্তর্জাতিক বাজারে ভাবমূর্তি উন্নয়নের ফলে বেশি পরিমাণে বৈদেশিক ঋণ পাওয়া সুবিধাজনক হতে পারে বলে মনে করছেন অর্থ বিশেষজ্ঞরা। বহির্বিশ্বে জাতি হিসাবে দেশের মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ায় বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগে আরও উৎসাহী হবে। নতুন করে অনেক দেশের সঙ্গে নতুন নতুন ব্যবসা-বাণিজ্যেরও সুযোগ তৈরি হবে।
এলডিসি উত্তরণে নিয়মানুযায়ী আনুষ্ঠানিক ঘোষণার জন্য ৩ থেকে ৫ বছর প্রস্তুতিকালীন সময় পাওয়া যায়। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ৫ বছরের প্রস্তুতিকালীন সময় চেয়ে আবেদন করেছে। তিনটি শর্ত পূরণ হলে এবং পরপর দুটি পর্যালোচনায় মানদ- ধরে রাখতে পারলে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সুপারিশ করে সিপিডি। ২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশ তিনটি শর্তই পূরণ করে আসছে। আবার মানদ-ও ধরে রেখেছে। তিনটি শর্ত হলো- মাথাপিছু আয় কমপক্ষে ১২৩০ মার্কিন ডলারে রাখা। ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিলো ১৮২৭ ডলার। মানবসম্পদ সূচকে ৬৬ পয়েন্ট ও অর্থনীতির ভঙ্গুগুরতা সূচকে ৩২ বা নিচে আনা। বাংলাদেশ এসব শর্তও ২০১৮ সাল থেকে পূরণ করে আসছে। মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের পয়েন্ট ৭৫.৩ এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুগুরতা সূচকে ২৫.২।