স্টাফ রিপোর্টার: বাজারে কোনো পণ্যেই স্বস্তি মিলছে না ক্রেতার। দেশীয় উৎপাদিত বা আমদানি করা কোনো পণ্য নিয়েই সুখবর নেই। ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত মুনাফা করার প্রবণতা, মজুত করে পণ্যের কৃত্রিম সংকট, টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বাড়া এবং আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়াসহ প্রতিনিয়তই কোনো না কোনো অজুহাতে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। তাই স্বস্তিতে নেই মানুষ। ব্যয় কমিয়েও আয়ের সঙ্গে সমন্বয় করতে পারছেন না তারা। এ পরিস্থিতি উত্তরণে বাজার ব্যবস্থাপনায় আরও কঠোর নজরদারির তাগিদ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। সরেজমিনে বাজার ঘুরে দেখা যায়, ক্রেতারা কোনো একটি দোকানে আটা-ময়দা পেলেও হয়তো চিনি পাচ্ছেন না। আবার কোথাও গিয়ে চিনি মিললেও সেখানে নেই সয়াবিন তেল বা আটা। আবার কোথাও এসব পণ্যের মোড়কজাত দু-একটি প্যাকেট থাকলেও নেই খোলা পণ্য। এ কারণে কাক্সিক্ষত পণ্য পেতে এক দোকান থেকে অন্য দোকানে ছুটতে হচ্ছে ক্রেতাদের। কেউ আবার বাধ্য হয়ে বেশি দামে পণ্য কিনছেন। নানা অজুহাতে কয়েক সপ্তাহ ধরে বাড়ছে চিনির দাম। আন্তর্জাতিক বাজারে কয়েক মাস ধরে পণ্যের দাম কমলেও স্থানীয় বাজারে কমছে না। বরং ডলারের দাম বাড়ার অজুহাতে পণ্যের দামও বেড়ে যাচ্ছে। ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে চিনি ও তেলের দাম নির্ধারণ করে দেয় সরকার। প্রতি কেজি খোলা চিনি ১০২ ও প্যাকেটজাত চিনি ১০৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়। তবে বাজারে সেই নির্ধারিত দামে চিনি বিক্রি হচ্ছে না। সাদা চিনি খোলাটা কেজি ১২০ টাকা। প্যাকেট সাদা চিনি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৩০-১৩৫ টাকা। বাজারে দেশি লাল চিনি প্যাকেট কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৪০-১৪৫ টাকা করে। মিল মালিক ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডলারের দাম বাড়ার কারণে কয়েক মাস ধরে টানা চিনির দাম বাড়ছে। এখন ব্যাংকে এলসি (ঋণপত্র) খোলার পরিমাণ কমে যাওয়ায় দেখা দিয়েছে সরবরাহ সঙ্কট। খুচরা ব্যবসায়ীরা অভিযোগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, চিনি ৯৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০৮ টাকা করেছে মিল মালিকরা। তারপরও চাহিদা মতো পাওয়া যাচ্ছে না। বাজারে কথা হয় ক্রেতা আমেনা খাতুনের সঙ্গে। তিনি বলেন, দুই মাস ধরে চিনি নিয়ে অস্থিরতা চলছে। শুধু চিনি না বাজারে গেলেই নাজেহাল অবস্থা। সবকিছুর অতিরিক্ত দামের কারণে নিজেকে অসহায় মনে হয়। কান্না আসে। প্রশাসনের কাছে প্রশ্ন, বাজার আর কতদিন পরে শান্ত হবে? তেলের দশাও একই। সর্বশেষ ১৭ নভেম্বর নতুনভাবে দাম বাড়ানো হয় ভোজ্যতেলের। এক লাফে লিটারপ্রতি ১২ টাকা বাড়িয়ে খোলা সয়াবিনের দাম ঠিক করা হয় ১৭২ টাকা এবং বোতলজাত সয়াবিন তেল প্রতিলিটারের দাম নির্ধারণ করা হয় ১৯৫ টাকা। তবে বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন বিক্রি হয়েছে ১৮৫ টাকা। এক মাস আগে (অক্টোবর) বিক্রি হয়েছে ১৬৬ টাকা। এছাড়া বোতল সয়াবিন প্রতি লিটার বিক্রি হয়েছে ১৯৫-২০০ টাকা। যা এক মাস আগে বিক্রি হয়েছে ১৮৫ টাকা। তারপরও অনেকে দোকানে তীর, পুষ্টি, রুপচাঁদার কোনো তেল পাওয়া যাচ্ছে না। পাঁচ লিটারের তেল পাওয়া গেলেও এক ও দুই লিটার তেল সব জায়গায় পাওয়া যাচ্ছে না। দেশের দ্বিতীয় প্রধান খাদ্যপণ্য আটা নিয়ে ফের শুরু হয়েছে নতুন কারসাজি। সব দোকানেই প্যাকেটজাত ও খোলা আটার দাম বেড়েছে। এখন প্রতিকেজি খোলা আটা বিক্রি হচ্ছে ৬৫ টাকা থেকে ৭০ টাকায়। যা আগে ছিল ৫০-৫৫ টাকা কেজি। দুই কেজি ওজনের প্যাকেটজাত আটা বিক্রি হচ্ছে ১৪৫-১৫০ টাকা। যা আগে ছিল ১২৫-১৩৫ টাকা। ময়দা খোলা প্রতিকেজিতে ১০ টাকা বেড়ে ৭০-৭৫ এবং প্যাকেট ময়দা ৫-১০ টাকা বেড়ে ৭৫-৮৫ টাকা। বাড্ডার বাজারের মুদি দোকানি সুমন বলেন, হঠাৎ করেই আটার দাম বেড়ে গেছে। কেজিতে ১০-১৫ টাকা করে বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাজারে স্পালাইও কম। সরকারি বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যমতে, গত একবছরে চিনির দাম বেড়েছে ৪৬ শতাংশ, ভোজ্যতেলে ৫ থেকে ২৫ শতাংশ, আটা ও ময়দায় মানভেদে ৫২ থেকে ৬৬ শতাংশ, চাল মানভেদে ১০-১১ শতাংশ এবং ডালে ২০-৪৭ শতাংশ পর্যন্ত দাম বেড়েছে। ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে শত শত টন চিনি মজুত করে অতিরিক্ত মুনাফা হাতিয়ে নিয়েছে, সম্প্রতি কয়েকটি অভিযানে বেরিয়ে এসেছে সেসব চিনি। এর আগে ভোজ্যতেল ও চাল নিয়ে একই ঘটনা দেশে ঘটেছে। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, চিনি, ভোজ্যতল, ডাল ও গমের (আটা) আমদানি করছে দেশের কয়েকটি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের মনোপলি ব্যবসার কারণে বাজারের এই অস্থিরতা। কৃত্রিম সঙ্কট দেখিয়ে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে অতিরিক্ত মুনাফা করা হচ্ছে এটা প্রমাণিত। পুরো ব্যবসায়ী সমাজই যেন নষ্ট হয়ে গেছে। সর্বত্র কারসাজি ও অতিরিক্ত মুনাফা করার প্রবণতা। এটা থেকে ব্যবসায়ীদের বেরিয়ে আসতে হবে। গত ২৬ নভেম্বর রাজশাহী সার্কিট হাউসে ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন বলেন, ‘বাজারে চিনির কোনো অভাব নেই। তারপরও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে সরকার নির্দেশনা দিয়েছে, এক লক্ষ টন চিনি যেন আমদানি করা হয়। কৃত্রিম সংকট দ্রুতই চলে যাবে। দেশে অন্যান্য পণ্যেরও কোনো সংকট নেই। কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বিশেষ মহল পণ্যের দাম বাড়ানোর অপচেষ্টা করছে। সরকার এই অপকর্মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে। আমরা বাজার মনিটরিং করছি’।
পূর্ববর্তী পোস্ট
পরবর্তী পোস্ট
এছাড়া, আরও পড়ুনঃ