রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন এবার আলোর মুখ দেখবে কি

স্টাফ রিপোর্টার: প্রায় সাড়ে সাত বছর আগে ২০১৭ সালে মানবিক দিক বিবেচনা করে মিয়ানমার থেকে আসা নির্যাতিত রোহিঙ্গা নাগরিকদের আশ্রয় দেয়া হয়েছিল। ধারণা ছিল, পরিস্থিতি শান্ত হলে এক পর্যায়ে তাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে দেয়া যাবে। কিন্তু সেই মানবিকতা বাংলাদেশের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে পরবর্তী সময়ে। গণহত্যা ও নির্যাতনের মুখে নানা সময়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা নাগরিকের সংখ্যা এখন ১২ লাখের বেশি। এই সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। আগামী দিনে এই রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের জন্য বড় সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়াবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
শুরু থেকেই রোহিঙ্গা নাগরিকদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে বাংলাদেশ চেষ্টা চালিয়ে আসছে। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে এ ব্যাপারে চুক্তিও করেছিল। তবে নানা ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়ে একজন রোহিঙ্গাকেও নিজ দেশে ফেরত নেয়নি মিয়ানমার। এতে বাংলাদেশের ওপর সেই বোঝা শুধু বেড়েছেই। সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের জন্য বিদেশি বরাদ্দ সীমিত হয়ে পড়ার পর রোহিঙ্গাদের নিয়ে নতুন করে সংকটে পড়েছে বাংলাদেশ।
তবে রোহিঙ্গা ইস্যুতে নতুন করে আশার আলো জ্বালালেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। গতকাল বাংলাদেশ সফরে এসে আজ তিনি ছুটে গেলেন কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। দিনভর সেখানে কাটালেন। সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসও ছিলেন। তারা এক লাখ রোহিঙ্গা নাগরিকের সঙ্গে ইফতারও করেছেন। সেখানে দেয়া বক্তব্যে জাতিসংঘ মহাসচিব রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে নতুন প্রত্যাশার কথা জানিয়েছেন। রোহিঙ্গাদের পক্ষে নিজের দৃঢ় অবস্থানের কথাও তুলে ধরেছেন।
একই অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে নতুন আশার কথা শুনিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, বর্তমান সরকার এ ব্যাপারে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছে। তিনি আশা করছেন, আগামী রোজার ঈদ রোহিঙ্গারা তাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে নিজেদের আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে করতে পারবেন।
তাদের এই বক্তব্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে নতুন করে আশার সঞ্চার হয়েছে। এবার রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান মিলতে পারে বলে প্রত্যাশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এই উদ্যোগে রোহিঙ্গারাও তাদের সন্তুষ্টির কথা জানিয়েছেন। তারা নিজ দেশে ফিরতে উদগ্রীব বলে জানিয়েছেন। জাতিসংঘ মহাসচিবকে নিজ দেশে ফেরার মতো পরিবেশ করতে অনুরোধ জানিয়েছেন রোহিঙ্গা প্রতিনিধিরা। রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবির ঘুরে দেখে সাংবাদিকদের সামনে ব্রিফিংকালে এ আহ্বান জানান তিনি। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে ইফতারে অংশ নিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, পবিত্র রমজান মাসে আমি সংহতির বার্তা নিয়ে কক্সবাজারে এসেছি। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি সংহতি জানাই। আর তাদের উদারভাবে আশ্রয় দেয়া বাংলাদেশি জনগণের প্রতিও আমার সংহতি রইল। আমি এখানে এসেছি শুধু তাদের দুর্দশার কথা তুলে ধরার জন্য নয়, বরং তাদের সম্ভাবনার ওপর বৈশ্বিক দৃষ্টি আকর্ষণে করতেও। এখানে বসবাসকারী ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী আত্মসম্মানবোধ-সম্পন্ন। তারা সংগ্রামী। বৈশ্বিক সমর্থন তাদের প্রয়োজন।’ জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, কয়েক দশকের বৈষম্য ও নিপীড়নের পর আট বছর আগে রাখাইন রাজ্যে ভয়াবহ গণহত্যার ফলে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা দেশ (মিয়ানমার) ছাড়তে বাধ্য হন। সম্প্রতি আরও অনেক রোহিঙ্গা এসেছেন, যারা নির্মম নির্যাতনসহ মানবাধিকার লঙ্ঘন থেকে বাঁচতে পালিয়ে এসেছেন, যা সামগ্রিকভাবে মুসলিমবিরোধী বিদ্বেষকে উসকে দিয়েছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীরা এখানে এসেছেন সেই মৌলিক চাহিদার জন্য, যা বিশ্বের যেকোনো মানুষেরই থাকে—সুরক্ষা, সম্মান এবং নিজেদের ও পরিবারের নিরাপত্তা। আমি আজ অনেকের সঙ্গে দেখা করেছি ও কথা বলেছি তাদের সাহস আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে, আর তাদের দৃঢ়চেতা মনোভাব আমাকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে।
আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, অনেকেই মিয়ানমারে তাদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা এবং এখানে আসার পথের কষ্টকর অভিজ্ঞতা শুনিয়েছেন। তারা নিজ দেশে ফিরে যেতে চান মিয়ানমারই তাদের মাতৃভূমি। নিরাপদ, স্বেচ্ছায় ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসনই এই সংকটের মূল সমাধান। এদিকে ইফতারে অংশ নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস রোহিঙ্গাদের উদ্দেশে বলেছেন, এই ঈদে না হোক, তবে আগামী রোজার ঈদ যেন আপনারা নিজ মাতৃভূমিতে স্বজনদের সঙ্গে উদযাপন করতে পারেন, সে লক্ষ্যে আমরা সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। প্রধান উপদেষ্টা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সহজে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, জাতিসংঘের মহাসচিব তার শত ব্যস্ততার মাঝেও আপনাদের সঙ্গে ইফতার করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন, যা আমাদের জন্য সত্যিই সৌভাগ্যের বিষয়। আজ তিনি আপনাদের সঙ্গে ইফতার করছেন, এটি তার আপনাদের প্রতি আন্তরিকতা ও সহমর্মিতার প্রতীক। রোহিঙ্গাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনারা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে জাতিসংঘের মহাসচিবকে যে অনুরোধ জানিয়েছেন, আমরা তা গুরুত্বের সঙ্গে তার কাছে উপস্থাপন করছি। আপনাদের যত দ্রুত সম্ভব নিজ দেশে ফেরানোর ব্যবস্থা করা যায়, আমরা নিরলসভাবে সেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আপনাদের সমস্যাকে গুরুত্ব দিয়ে এত দুনিয়ায় ঝামেলা, কোথাও কোথাও যুদ্ধ চলছে, এত কিছুর পরও জাতিসংঘ মহাসচিব এখানে এসেছেন আপনাদের কথা শুনতে। শুধু আপনাদের সঙ্গে ইফতার করবে বলে এত দূর থেকে এসেছেন তিনি, যেন এটার সমাধান হতে পারে। এজন্য আমরা সবাই তাকে ধন্যবাদ জানাই।
রোহিঙ্গাদের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরাতে সারা দুনিয়ার সঙ্গে প্রয়োজনে লড়াই করতে হবে। ঈদে মানুষ আত্মীয়-স্বজনের কবর জিয়ারত করে। রোহিঙ্গাদের সেই সুযোগও নেই।
এদিকে রোহিঙ্গা প্রতিনিধিরা জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে মতবিনিময়কালে জানিয়েছেন, তারাও নিজ দেশে ফিরতে চান। তারা রাখাইন রাজ্য হওয়া গণহত্যার বিচার দাবি করেন এবং জাতিসংঘ মহাসচিবকে নিজ দেশে ফেরার পরিবেশ করার আহ্বান জানান।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More