বিএনপির সঙ্গে বসলে আমি পোড়া মানুষগুলোর গন্ধ পাই : আলোচনা প্রত্যাখ্যান
ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগকে দেয়া সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
স্টাফ রিপোর্টার: বিএনপির সঙ্গে আলোচনার বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘মনে হয়, ওদের সঙ্গে বসলে আমি পোড়া মানুষগুলোর গন্ধ পাই। পোড়া মানুষগুলোর কষ্ট দেখলে আর ওদের (বিএনপির) সঙ্গে বসতে ইচ্ছে হয় না।’ তিনি বলেন, ‘তাদের সঙ্গে ডায়লগ, আমি ডায়লগ কীভাবে করব? ঠিক আছে, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পরও কিন্তু তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে। আমি জানি, সে বিচারও কিন্তু তারা করেনি। খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে মারা গেছে, লাশ এসেছে। আমি কিন্তু প্রাইম মিনিস্টার। তবুও গেলাম সন্তানহারা মাকে সহানুভূতি জানাতে। আমি যখন রওনা হয়েছি তখন জানানো হলো ওই বাড়িতে (খালেদা জিয়ার বাড়ি) ঢুকতে দেবে না। মেইন গেট বন্ধ। আমি তখন বললাম, এসেই যখন পড়েছি মেইন গেট না হয় না খুললো যেটা পকেট গেট আছে সেখান দিয়েই যাবো। আমাকে এসএসএফ নিতে আসছে। যেই গাড়ি থেকে নামবো, পেছন থেকে দরজাটা বন্ধ করে দিলো। আমাকে ঢুকতে দিলো না। আমাকে না ঢুকতে দিয়ে চরম অপমান করা হলো। আপনারা বলেন, এরপর কার সঙ্গে ডায়লগ করবো আমি?’ মার্কিন সংবাদ মাধ্যম ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগকে দেয়া সাক্ষাৎকারে নিজের এ অবস্থানের কথা ব্যক্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী। ছয় দিনের সফরে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর প্রতি প্রশ্ন ছিল, নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে বিএনপি আন্দোলন করছে। বিএনপি নেতাদের সঙ্গে আলোচনার চিন্তা-ভাবনা কি আপনাদের আছে? এ সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা কিন্তু বারবার আলোচনা করেছি, ২০১৮ সালের নির্বাচনেও। কিন্তু আসলে বিএনপি এমন একটি রাজনৈতিক দল যেটি সৃষ্টি করেছে একজন সামরিক শাসক। যে ১৯৭৫ সালে আমার বাবা, মা, ভাই, বোনকে হত্যা করেছে। একজন প্রেসিডেন্টকে হত্যা করে পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে।’ বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে ইঙ্গিত করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘একজন সেনাপ্রধান নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা দিয়ে চেয়ারে বসলো। বসে হ্যাঁ-না ভোটের নামে নাটক, সেখানে না নয়, সব হ্যাঁ ভোটই হয়ে গেল। পরে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ১৯৭৭ সালে করলো। এরপরে গিয়ে রাজনৈতিক দল সৃষ্টি করলো, ক্ষমতায় বসে থেকে। এ কথাটা সবাইকে মনে রাখতে হবে, অস্ত্র হাতে নিয়ে ক্ষমতা দখল করে, ক্ষমতায় বসে থেকে যে রাজনৈতিক দল সৃষ্টি করা হয়েছে সেটাই হচ্ছে বিএনপি।’ বিএনপির সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা আরও বলেন, ‘আলোচনার কথা যদি বলেন। দেখুন, আমার মা-বাবা-ভাইদের যারা হত্যা করেছে সেই হত্যাকারীদের বিচার আমি কোনো দিন চাইতে পারিনি। ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে এসে মামলা করতে পারিনি। ক্ষমতায় এসে যখন মামলা করলাম, যেদিন রায় দেবেন সেদিন হরতাল ডেকেছে বিএনপি। যাতে জজ সাহেব কোর্টে গিয়ে রায় দিতে না পারেন।’ বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘ক্ষমতায় ছিল আবার আমার বাবা-মা ও ভাইদের হত্যাকারী, যুদ্ধাপরাধী। তারপরও দেশের স্বার্থে, দেশের গণতন্ত্রের স্বার্থে আমি কিন্তু তাদের সঙ্গে আলোচনাও করেছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো ২০১৮ সালের নির্বাচনেও তারা বলতে গেলে। সিট বিক্রি করা। একেকটা সিটের পেছনে দু’জন-তিনজনকে নমিনেশন। একজনকে লন্ডন থেকে পাঠায়, আর ঢাকা থেকে কেউ দেয়। এভাবে একেক সিটে দুই-তিন করে ক্যান্ডিডেট। তারা দেখল ইলেকশন করার আর অবস্থা নেই, তখন তারা এক সময় ইলেকশন থেকে উইথড্র করে চলে যায়। ইলেকশনটাকে তারা কন্ট্রোভার্সিয়াল করার চেষ্টা করে।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘কেয়ারটেকার সরকারের ব্যবস্থা বিএনপিই নষ্ট করে দিয়ে গেছে। খালেদা জিয়া নিজেই বলেন, পাগল আর শিশু ছাড়া নিরপেক্ষ কেউ নেই। সেখানে তারা কীভাবে এই দাবি করেন? সেটাই হলো বড় প্রশ্ন।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘একে তো সাজাপ্রাপ্ত আসামি। তারপর আবার বাবা-মা, ভাই-বোনদের খুনি, যুদ্ধাপরাধী। তারপরও দেশের স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে, দেশের জনগণকে রক্ষার জন্য কিন্তু অনেক উদারতা দেখিয়েছি। তবে এখন আর তাদের সঙ্গে কথা বলার কিছু নেই। কারণ তাদের যে অপরাধ। আমার ২১ হাজার নেতাকর্মীকে তারা হত্যা করেছে।’ সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী জানান, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে এনে তার বিরুদ্ধে হওয়া সাজা কার্যকর করা হবে। তিনি বলেন, ‘তারেক রহমান এখন যুক্তরাজ্যে, রাজনৈতিক আশ্রয়ে আছেন। তিনি গ্রেনেড হামলাসহ নানা মামলার আসামি। তাকে ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে যুক্তরাজ্য সরকারের সঙ্গে আপনাদের কি কোনো আলোচনা হয়েছে-এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অবশ্যই। এক সময় তার বিরুদ্ধে যে সাজা দেয়া হয়েছে সে জন্য আমাদের পক্ষ থেকে বারবার যুক্তরাজ্য সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা। একটা অপরাধী, সে ওখানে। যে অপরাধী হোক, তাদের তো ফিরিয়ে নিয়ে সাজাটা কার্যকর করা উচিত। সে ব্যাপারে আমরা প্রচেষ্টা চালাচ্ছি।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘তবে এটা এখন সম্পূর্ণ নির্ভর করে ব্রিটিশ গভর্মেন্টের ওপর। তারা কী সেই আসামি ওখানে রেখে লালন-পালন করবে, না শাস্তিটা কার্যকর করতে দেবে। এটা তাদের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করছে।’ প্রধানমন্ত্রী তার সাক্ষাৎকারে আরও বলেন, ‘বিশ্বজুড়ে যখন জঙ্গিবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল, তখন যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শেই র্যাব সৃষ্টি করা হয়েছিল। হঠাৎ এই বাহিনীটির ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা বোধগম্য নয়। র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়ায় জঙ্গিরা এখন উৎসাহিত হয়েছে।’ সাক্ষাৎকারে র্যাবের সংস্কারে বাংলাদেশ সরকার কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে, এমন প্রশ্নে শেখ হাসিনা বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শেই র্যাব সৃষ্টি। তাদের ট্রেনিংসহ সবকিছুই আমেরিকার করা। কিন্তু কেন র্যাবকে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলো, তা প্রশ্নবিদ্ধ। বাহিনীতে কেউ কোনো ধরনের অপরাধ করলে তাদের সঙ্গে সঙ্গে আইনের আওতায় নিয়ে আসায় হয়, যা অন্য দেশে নেই। এমনকি আমেরিকাতেও নেই। তারপরও এ ধরনের ঘোষণা দুঃখজনক।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের এক প্রতিমন্ত্রীর মেয়ের স্বামী, সে একটা অপরাধ করেছে, সঙ্গে সঙ্গে তাকে গ্রেপ্তার ও জেলে দেয়া হয়। সে শাস্তি পেয়েছে। আমরা কিন্তু এভাবেই দেখি।’ র্যাবের সংস্কার প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘সন্ত্রাস ও জঙ্গি দমনে র্যাবের ভালো ভূমিকা আছে। র্যাবের যে কোনো কর্মকর্তা অপরাধ করুক না কেন, শাস্তির আওতায় আনা হয়। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় আমরা সবসময় সচেতন। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকার আসার পর থেকে আরও বেশি।’