কার্পাসডাঙ্গা প্রতিনিধি: কালের বিবর্তনে অনেক কিছুই হারিয়ে যাচ্ছে। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে অনেকেরই বদলাতে হচ্ছে তাদের পৈত্রিক পুরাতন পেশা। কেউ কেউ মানবতর জীবনযাপন করলেও পুরাতন পেশা আখাড়েই জীবনটা পার করার সিদ্ধান্তে অটল। এদেরই একজন চুয়াডাঙ্গা দামুড়হুদার কার্পাসডাঙ্গার শফিকুল ইসলাম। বয়স ষাটের কোঠায়। তিনি আখড়ে রয়েছেন গরুরগাড়ির চাকা তৈরি করার পেশা। যখন বৈধ অবৈধ যানের উৎপাতে অতিষ্ঠ সাধারণ মানুষ, তখন গরুরগাড়ির চাকা তৈরি পেশায় কি পেট চলে?
এলাকার অনেকেই মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, একসময় আয় উর্পাজনের জন্য গরুর গাড়ি চালানোকে অনেকে পেশা হিসেবে গ্রহন করত। রাস্তা দিয়ে গরুর গাড়ি আসা যাওয়ার সময় বিশেষ করে রাতে গ্রামবাসীর ঘুম ভেঙে যেত গরুর গলার ঘুংগুরা ও গাড়ির চালকের শব্দে। অতিরিক্ত মালামাল নিয়ে গাড়ি গর্তে পড়ে গেলে চালকসহ রাস্তায় চলাচলরত লোকজন মিলে গাড়ী তুলে নেওয়া হত। রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালানোর সময় গরুর ক্ষুধা লাগলে চালক কোন স্থানে গাড়ি দাড় করিয়ে গরুকে খাবার দিত। গরুর গাড়ির প্রচলনের সময় অনেকে গাড়ি তৈরী করে সংসার চালাত। গাড়ি তৈরীর কারিগরগুলো ছিল অভিজ্ঞ নিপুন শিল্পী। সেই সময় গাড়ির জন্য বলবান গরুর কদর ছিল অত্যধিক। আধুনিক প্রযুক্তির ভীড়ে গরুর গাড়ি আজ বিলুপ্ত হতে চলেছে। যে কারনে ভাল নেই গরুর গাড়ির চাকা তৈরীর কারিগররা। তবুও বংশ পরমপরায় বাপ-দাদার এ পেশাকে আঁকড়ে ধরে আছেন চাপাইনবাবগঞ্জ থেকে ৩৫ বছর আগে দামুড়হুদা উপজেলার কার্পাসডাঙ্গায় আসা গরুর গাড়ির চাকা তৈরীর কারিগর শফিকুল ইসলাম (৫২)। সরেজমিনে উপজেলার কার্পাসডাঙ্গা গ্রামের কাউন্সিল মোড়ের অক্সফোর্ড কিন্ডারগার্টেন এর সামনে গেলে চোখে পড়ে শফিকুল ইসলামের গরুর গাড়ির চাকা তৈরীর দৃশ্য। এ সময় কাজের ফাঁকে কথা হয় তার সাথে। তিনি বলেন, আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ায় গরুর গাড়ির ব্যবহার কমে যাওয়ায় এখন এ পেশা প্রায় বিলুপ্তির পথে। তবুও নাড়ির টানে বাপ-দাদার এ পেশাকে আঁকড়ে ধরে আছি। তার পূর্ব পুরুষরা এ পেশায় থেকে তাদেরকে মানুষ করেছেন। শফিকুল আরো বলেন, শুধু বাবলার কাঠ থেকেই গরুর গাড়ি চাকা তৈরী হয়। একজোড়া চাকা তৈরীতে সপ্তাহ খানেক সময় লাগার কথা উল্লেখ করে বলেন, প্রতিটি তৈরীকৃত ৯ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকায় বিক্রি করে থাকেন। যা সাধারনত ভুট্টু, পাট ও ধানের সময় পর্যন্ত চাহিদা থাকে। পরের ৬ মাস বসে থাকি। আগে হাটে চাকার চাহিদা অনেক ছিল। বিভিন্ন এলাকা থেকে চাকা কিনতে আসত। কিন্তু একযুগ ধরে এই চাকার চাহিদা কমে যায়। এখন যান্ত্রিক যুগের কারনে গরুর গাড়ির চাকা বিক্রি হয় না। এখন মাসে ৪ জোড়া তৈরী করি। এভাবেই তিনি পরিবার-পরিজনের মুখে দু’বেলা দু’মুঠো অন্ন জুগিয়ে চলেছেন। অনেক দুঃখের সাথে আরো বলেন, এক সময় গ্রামের পথ-ঘাট ছিল অনুন্নত। গ্রামের প্রায় প্রতিটি গৃহস্থ পরিবারে ছিল গরুর গাড়ি। তখন গরুর গাড়ির চাকা তৈরীতে ভীড় সামলানোই ছিল কঠিন। কিন্তু সময় পাল্টেছে। এখন পাওয়ার টিলার, ট্রাক্টরসহ আধুনিক প্রযুক্তির ভীড়ে গরুর গাড়ি প্রায় বিলুপ্তি হতে চলেছে। এখন আমি একাই কাজ করি। ৩৫ বছর আগে কার্পাসডাঙ্গায় এসেছি। ৬ মাস নিজ জেলায় থাকি আর ৬ মাস কার্পাসডাঙ্গায় থাকি। আগে প্রতি মাসে ১০ জোড়া পর্যন্ত চাকা বিক্রি করেছি। স্ত্রী, ৩ সন্তান আছে সংসারে। আমি এই কারখানায় চাকা তৈরী করি আর এখানেই রাতে থাকি। নিজেই রান্না করে খাওয়া দাওয়া করি। তবে গরু মহিষের গাড়ির চাকার কারিগর ও উপাদান সংকটের কারণে এ শিল্পের ভবিষ্যত নিয়ে শংকা রয়েই যাচ্ছে বলে তিনি জানান।