স্টাফ রিপোর্টার: দর্শনা কেরুজ চিনিকল জেলার একমাত্র অর্থনৈতিক রাষ্ট্রায়াত্ব শিল্প প্রতিষ্ঠান। সার্বিক হিসেব নিকেশে প্রতিষ্ঠানটি সরকারকে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব দিয়েও প্রতিবছরই মুনাফা অর্জন করে থাকে। তবে চিনি উৎপাদন বিভাগের লোকশান কোনোভাবেই রোধ করা যাচ্ছে না। আখ উৎপাদন করতে গিয়ে কৃষি খামারগুলোতে প্রতিবছরে গড়ে প্রায় ৪ কোটি টাকা লোকশান হয়ে থাকে। কি কারণে লোকশান হচ্ছে তা সকরেরই জানা। সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে চিনিকল কর্তৃপক্ষ বেশকিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তার মধ্যে কৃষি খামারের জমি আখ লাগানোর শর্তে লিজের আওতায় আনার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এতে করে বাড়তি আয়ের পাশাপাশি আখের ঘাড়তি থাকবে না বলে কর্তৃপক্ষ মনে করছে। কৃষি খামারগুলোর জমি লিজ দিতে এরই মধ্যে বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করেছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে চলতি মরসুমেই বাড়তি ১ কোটি ২০ লাখ টাকা বাড়তি আয় করবে বলে মনে করছে।
জানা গেছে, ১৯৩৮ সালে চুয়াডাঙ্গার দর্শনায় প্রতিষ্ঠিত হয় দর্শনা কেরুজ চিনিকলটি। যা বাংলাদেশের শিল্প স্থাপনাগুলোর মধ্যে কেরু অ্যান্ড কোম্পানী (বাংলাদেশ) লিঃ একটি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানের প্রধান কাঁচামাল হচ্ছে আখ। যা চিনিকল কর্তৃপক্ষ এবং এলাকার চাষিরা উৎপাদন করে থাকে। আর উৎপাদিত আখ চিনিকলে সরবরাহ করে থাকে এলাকার আখচাষিরা। আর আখ চাষের জন্য চিনিকল কর্তৃপক্ষ সর্বপ্রকার ঋণযুক্ত সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে থাকে। চিনিকল সূত্রে জানাগেছে, গত মরসুমে চিনিকলের আওতায় আখ ছিলো ৭ হাজার ৩৭৫ একর। চলতি মরসুমে আখ চাষ হয়েছে ৮ হাজার ৫৩২ একর জমিতে। গত বছরের তুলনায় এ বছর আখ চাষ বেশি হয়েছে ১ হাজার ১৫৭ একর। এ প্রতিষ্ঠানের কৃষি খামারের আওতায় মোট জমির পরিমাণ (হিজলগাড়ি, বেগমপুর, ফুরশেদপুর, ঝাঝরি, আড়িয়া, ফুলবাড়ি, ছয়ঘরিয়া, ঘোলদাড়ী ও ডিহি) ৩ হাজার ৩৩৫ দশমিক ৫৬ একর। এর মধ্যে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ ৩ হাজার ৫৫ দশমিক ৮৪ একর। আর আকন্দবাড়ীয়া পরীক্ষামূক বীজ উৎপাদন খামারে রয়েছে ২৭৯ দশমিক ৭২ একর। প্রতি মরসুমে চিনিকল কর্তৃৃপক্ষ গড়ে প্রায় ১ হাজার ৫শ একর জমিতে আখ রোপণ করে থাকে। যা থেকে প্রায় ২ হাজার ৫শ মে.টন আখ উৎপাদন হয়। যার মূল্য দাঁড়ায় ৭ কোটি ৭৫ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। শুধুমাত্র আখ উৎপাদনে খরচ হয় গড়ে ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৮৭ হাজার টাকা। প্রতিবছর ৯টি কৃষি খামারে লোকশান হয় প্রায় ৩ কোটি ৭০ লাখ ৬০ হাজার টাকা। আর বাকি জমি অলস পড়ে থাকে। অলস জমির কিছু অংশে কর্তৃপক্ষ খ-কালিন সময় সবজিসহ ডাল চাষ করে থাকে। সার্বিক হিসাব নিকাশে কৃষি খামারে লোকশান হলেও ডিস্টিলারি বিভাগের ওপর ভর করে সরকারকে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব দিয়েও মুনাফা অর্জন করে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। তবে চিনি উৎপাদন বিভাগে কোনোভাবেই লোকশান ঠেকাতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। সে দিকটি মাথায় রেখে ৮২ বছরের মধ্যে এবারই প্রথম ৮টি কৃষি খামারের ১৮শ বিঘা জমি লিজ দিয়ে আখ লাগানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেছে কর্তৃপক্ষ। বাকি ৮৫০ একর জমিতে আখ আবাদ যথাসময়ে করতে পারবে কর্তৃপক্ষ। বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক যোগদানের পর লোকশানমুখী প্রতিষ্ঠানটিকে লাভজনক করতেই নানামুখি উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন বলে সাধারণ শ্রমিক-কর্মচারীরা মনে করছেন। আর আখ চাষের শর্তে এ কৃষি খামারের জমি লিজ নিতে মিলের মৌসুমী ও স্থায়ী শ্রমিক/কর্মচারী এবং কর্মকর্তারা অংশগ্রহণ করতে পারবে। কেউ ৫ একরের বেশি জমি নিতে পারবে না। এর মধ্যে ঘোলদাড়ি কৃষি খামার বাদে ফুরশেদপুরে ৮৩ একর, বেগমপুরে ১শ একর, ঝাঝরি ৭৭ একর, আড়িয়ায় ১১০ একর, হিজলগাড়িতে ৫০ একর, ডিহিতে ১২৫ একর, ফুলবাড়ি ১০ একর এবং ছয়ঘরিয়ায় ৪৫ একর জমি লিজ দেবার জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। যেখানে লিজের মেয়াদ ধরা হয়েছে ১ সেপ্টম্বর ২০২০ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২ সাল পর্যন্ত। এ লিজে কানামনা/চুক্তিভিত্তিক বা দৈনিক হাজিরায় নিয়োজিত কোনো শ্রমিক বা কর্মচারী অংশগ্রহণ করতে পারবে না। শুধু তাই নয় আখ চাষের সাথে সাথী ফসল হিসেবে কোনো অবস্থাতেই মিষ্টি কুমড়া, তরমুজ, ভুট্টা, তামাক, কলা বা পেঁপের চাষ করতে পারবে না। বিভিন্ন শর্তসাপেক্ষে ১৮ মাসের জন্য লীজ দেবার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। যেখানে জনসাধারণের অংশগ্রহণের কোনো সুযোগ নেই। আগামী ১০ অক্টোবর অংশগ্রহণকারী দরদাতাদের সামনে দরপত্র বাক্স খোলা হবে। এদিকে সঠিক পরিচর্জা করে আখ লাগাতে পারলে প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি লীজ গ্রহীতারাও লাভবান হবে বলে আখচাষিরা মনে করছেন। অন্যদিকে আখ আমাদের দেশের একটি জনপ্রিয় অর্থকারি ফসল। চিনি উৎপাদনের একমাত্র কাঁচামাল। কিন্তু চাহিদার তুলনায় আখ উৎপাদন অনেক কম। এর কারণও অনেক। সঠিক পরিচর্যা বা চাষাবাদের অভাব ফসলের বৈচিত্রতা, ফলন মেয়াদি সবজি ফসলের আবাদ বৃদ্ধি, ফলের বাগান তৈরি ইত্যাদি কারণে দিন দিন আখ চাষের জমি কমে যাচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে চিনিকল কর্তৃপক্ষ যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে তাতে উভয়েই লাভবান হবে। আখ চাষি জমির, তালেব, শুকুর আলী, জহির, ছানোয়ার, শহিদুল, সবুর, তাইজেল বলেন, সঠিক পরিচর্জা করে যদি আখ চাষ করা যায় একর প্রতি ২০ থেকে ২৫ টন আখ করা সম্ভব। যার মূল্য দাঁড়াবে ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকা। বর্তমানে কেরুজ চিনিকলে আখ বিক্রির টাকা পেতে ভোগান্তি পোহাতে হয় না চাষিদের। আখচাষি কল্যাণ সংস্থার সাধারণ সম্পাদক আব্দুল বারি বিশ্বাস বলেন, চিনিকল কর্তৃপক্ষ লাভজনক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একদিকে জমি লিজের টাকা অন্যদিকে আখ নিয়ে কোন টেনশন পোহাতে হবে না। শুধু চিনকলই লাভবান হবে না, যারা আখ লাগাবে তারাও লাভবান হবে বলে আমি মনে করি। এ ব্যাপারে উপ-ব্যবস্থাপক (মিলস ফার্ম) হুমায়ুন কবির বলেন, প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে আমাদের আখ চাষ করা দরকার। সেই সাথে জমি লিজ হলে প্রতিষ্ঠান আর্থিকভাবে লাভবান হবার পাশাাপাশি কৃষি খামারের লোকশান যেমন কমবে তেমনি চাহিদা মোতাবেক উৎপাদন হবে আখ। এখানে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সবাই লাভবান হবে। চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু সাঈদ বলেন, ঐতিহ্যবাহী এ চিনিকলটি এলাকার একমাত্র অর্থনৈতিক চালিকা শক্তি। এর সাথে জড়িত আছে অনেকের রুটিরুজি। প্রতিষ্ঠনটিকে লাভের জায়গায় নিয়ে যেতে অনেক কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। বিশেষ করে ফার্মের লোকশান কমাতে এরই মধ্যে দিন হাজিরার অপ্রয়োজনীয় পাহারাদার ছাটাই করা হয়েছে। তাতে করে বার্ষিক ২ কোটি টাকার মতো সাশ্রয় হবে। ৬শ একর জমি লিজ দিতে পারলে সেখান থেকেও প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ টাকা বাড়তি আয় হবে। রাষ্টায়াত্ব এ চিনকলটিকে বাঁচিয়ে রাখতে এলাকাবাসীকেই এগিয়ে আসতে হবে। প্রতিষ্ঠান টিকে না থাকলে কোনোকিছুই থাকবে না। প্রতিষ্ঠানের কেউ ক্ষতিসাধন করার চেষ্টা করলে তাকে এতটুকু ছাড় দেয়া হবে না। নিষ্ঠার সাথে যাতে দায়িত্ব পালন করতে পারি এর জন্য সকলের পরামর্শ এবং সহযোগিতা প্রয়োজন। আমার কাছে ব্যক্তির চাইতে প্রতিষ্ঠান বড়। জমি লিজ দিলে আখের ঘাটতির সাথে মিলবে প্রতিষ্ঠনের বাড়তি আয়।