ঐতিহাসিক ৭ মার্চ আজ

স্টাফ রিপোর্টার: ঐতিহাসিক ৭ মার্চ আজ। তৎকালীন রমনার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের দিন। ওই ভাষণ বাঙালির স্বাধীনতা-মুক্তি ও জাতীয়তাবোধ জাগরণের মহাকাব্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৯৭১ সালের এই দিনের পড়ন্ত বিকালে তিনি সমবেত লাখো জনতাকে সামনে রেখে বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ মাত্র ১৮ মিনিটের ভাষণে সেদিন বঙ্গবন্ধু যেমন বাঙালির দীর্ঘ সংগ্রাম ও আন্দোলনের পটভূমি তুলে ধরেছেন, তেমনি দেশবাসীর করণীয় সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। এক কথায় বলা যায়, এটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের রণকৌশল। তার এ ভাষণ ছিলো পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর প্রতি এক চরমপত্র। শব্দ ও বাক্য চয়নে, প্রক্ষেপণ স্টাইলে- সবমিলিয়ে শ্রুতিমাধুর্যে ভরা এই ভাষণটি কালের পরিক্রমার বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হয়ে উঠেছে। ২০১৭ সালে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেস্কো বিশ্ব ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল হিসেবে গ্রহণ করে ভাষণটিকে। সংস্থাটি বিশ্বের ৭৮টি ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ দলিল, নথি ও বক্তৃতার মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণও অন্তর্ভুক্ত করে। কালোত্তীর্ণ এ ভাষণটি সরাসরি সম্প্রচার করতে দেয়নি তখনকার পাকিস্তান সরকার। তবে, পরদিন বিভিন্ন পত্রিকায় তা ফলাও করে প্রকাশিত হয়। এদিন রেসকোর্সের ময়দানে বঙ্গবন্ধু মঞ্চে এসে যখন জনতার উদ্দেশে হাত নাড়েন তখন লাখ লাখ মুক্তিকামী মানুষের কণ্ঠে ‘তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ, তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব, শেখ মুজিব’ ধ্বনিতে উদ্যান প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু সামরিক শাসকগোষ্ঠী আওয়ামী লীগ তথা বাঙালিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে নানামুখী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। জবাবে ক্ষুব্ধ বাঙালি রাজপথে নেমে আসে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ২৩ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতিসত্তা, জাতীয়তাবোধ ও জাতিরাষ্ট্র গঠনের যে ভিত রচিত হয়, তারই চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে ৭ মার্চের ভাষণ দেন তিনি। সেই ভাষণে নতুন প্রেরণা খুঁজে পায় ছাত্র-কৃষক-শ্রমিকসহ সর্বস্তরের বাঙালি।
একাত্তরের এই দিনে ঢাকা ছিল লাখো মানুষের শহর। বিভিন্ন জেলা থেকে মানুষ ছুটে এসেছিল নেতার ভাষণ শুনতে। ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’ স্লোগানে ঢাকা শহর উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। কখন ঘটবে বিস্ফোরণ এমন একটি পরিস্থিতি বিরাজ করে সারা শহরে। শেখ মুজিব যদি নিজ মুখে স্বাধীনতার ঘোষণা করেন, তখন তাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বানিয়ে নির্বিচারে বাঙালি নিধনের ঘৃণ্য পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ভারী অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে প্রস্তুত ছিল পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী। কিন্তু তিনি সে সুযোগ দেননি হানাদারদের। টান টান উত্তেজনার মধ্যে রেসকোর্সে অনুষ্ঠিত হয় এই সমাবেশ। একাত্তরের এই দিনটিতে পাকিস্তানি শাসকদের শোষণের বিরুদ্ধে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো জেগে ওঠা পুরো বাংলাকে এক সুতোয় বাঁধেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার এই স্বপ্নদ্রষ্টা।
এই ভাষণে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য ২৩ বছরের লড়াই সংগ্রামের বর্ণনা, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচার নির্যাতনের অপচিত্র, সময়ভেদে বাঙালি জাতির করণীয় নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন তিনি। কোমলে-কঠোরে উচ্চারিত এই ভাষণ ছিল মুক্তিযুদ্ধের আলোকবর্তিকা। তার এ ভাষণই সেদিন সংশয়ে থাকা বাঙালির হৃদয়ে জাগিয়ে দিয়েছিল স্বাধীনতার স্বপ্ন। এই ভাষণের পরপরই বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।
সেদিন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘ভাইয়েরা আমার, আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, মানুষের অধিকার চাই।’ নির্দেশ দিয়েছিলেন, আজ থেকে কোর্ট-কাচারি, হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট, অফিস-আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সব অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। কোনো কর্মচারী অফিসে যাবেন না। আপামর জনসাধারণের উদ্দেশে বলেন, ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি…, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্র¤œর মোকাবিলা করতে প্রস্তুত থাক।’
এই জনসভায় মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশের নেতৃত্বে শহীদদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করা হয়।
একাত্তরের ৭ মার্চের ঘটনাবলি সম্পর্কে লেখক রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী তার ‘একাত্তরের দশ মাস’ বইয়ে উলেস্নখ করেছেন- আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর রুদ্ধদ্বার বৈঠকে স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে আলোচনা চলায় জনসভায় আসতে দেরি হয় বঙ্গবন্ধুর। তবে, এ জনসভায় তিনি তার জীবনের শ্রেষ্ঠ ভাষণটি দিয়েছিলেন। এ ভাষণে বেশ কিছু পরিকল্পনা ও কর্মসূচির ঘোষণাও দেন তিনি।’

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More