স্টাফ রিপোর্টার: রক্তাক্ত ও বিভীষিকাময় ২১ আগস্ট আজ। ১৯ বছর আগে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট পৃথিবীর ইতিহাসের জঘন্যতম নারকীয় ঘটনাটি ঘটে। এর আগে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঠিক একইরকম একটি হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে। সেই বিভীষিকার ২৯ বছর পর স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে ভয়ানক নৃশংসতম হত্যাকান্ডটি ঘটে ২০০৪ সালের এই দিনে। সেই একই মাস। শুধুমাত্র সময়-ক্ষণ, হত্যাযজ্ঞের ধরন ও হত্যাকারীর ব্যক্তিগত পরিচয় বদলেছে। ১৯৭৫ আর ২০০৪ সালের এই দুই হত্যাযজ্ঞের নিহতদের রক্তধারায় একই আদর্শ ও চেতনার অনুরণন। ‘৭৫ এ হত্যা করা হয়েছিল পিতা ও তার পরিবারের সদস্যদের, আর ২০০৪ সালে হত্যা করার প্রাণপণ চেষ্টা করা হয় তারই উত্তরাধিকার কন্যা ও অনুসারীদের। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ছিল শনিবার। বিকালের শুভ্র মেঘ তার সফেদ আভা ছড়িয়ে যাই যাই করছিল। দিনভর ঝাঁজালো রোদের তপ্ত উত্তাপ তখনো কমেনি। সে সময় দেশে একদিকে বাংলা ভাই ও শায়খ আব্দুর রহমানের উত্থান, অন্যদিকে দেশের বিভিন্ন স্থানে জঙ্গি ও বোমা হামলা চলছিল। এসব বোমা হামলার প্রতিবাদে সেদিন রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের সড়কে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের ডাকে সমাবেশ শেষে সন্ত্রাসবিরোধী শান্তি মিছিল হওয়ার কথা ছিল। তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে শুরু হয়ে মিছিলটি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে শেষ হবে এমনটি আগেই জানানো হয়েছিল। সে কারণে সমাবেশস্থলে মঞ্চ তৈরি না করে একটি ট্রাককে মঞ্চ হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছিল। সমাবেশে দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের বক্তব্যের পর বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বক্তব্য দিতে শুরু করেন। সময় তখন বিকেল ৫টা ২২ মিনিট। তার দুই পাশে ছিলেন মোহাম্মদ হানিফ, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াসহ আওয়ামী লীগের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা। ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে বক্তৃতা শেষ করে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা তার হাতে থাকা একটি কাগজ ভাঁজ করতে করতে এগোচ্ছিলেন ট্রাক থেকে নামার সিঁড়ির কাছে। ঠিক এ সময় শুরু হয় নারকীয় গ্রেনেড হামলা। বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হতে থাকে একের পর এক গ্রেনেড। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ মুহূর্তেই পরিণত হয় মৃত্যুপুরীতে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ১৩টি গ্রেনেড হামলার বীভৎসতায় মুহূর্তেই রক্ত-মাংসের স্তূপে পরিণত হয় সমাবেশস্থল। রক্তগঙ্গা বয়ে যায় এলাকাজুড়ে। রক্তে ভিজে লাল হয়ে যায় পিচঢালা কালো পথ। রক্তাক্ত মানুষের আর্তনাদ আর প্রাণপণ ছোটাছুটিতে তৈরি হয় বিভীষিকা। এরই মধ্যে পুলিশ একদিকে সড়কে টিয়ারশেল নিক্ষেপ করতে থাকে, অন্যদিকে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে তালা লাগিয়ে ভেতরে টিয়ারশেল ছুঁড়ে দেয়। সেখানে তখন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছেন। মূলত আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাসহ দলের শীর্ষ নেতাদের টার্গেট করে গ্রেনেড হামলা করা হয়েছিল। দলের নেতাকর্মী ও দেহরক্ষীদের আত্মত্যাগে বেঁচে যান ভয়ংকর এই গ্রেনেড হামলার প্রধান টার্গেট শেখ হাসিনা। মৃত্যুর জাল ছিন্ন করে অলৌকিকভাবে প্রাণে বেঁচে যান তিনি। মানববর্ম তৈরি করে তার জীবন রক্ষা করে প্রিয় নেত্রীকে গাড়িতে উঠিয়ে দেন তারই সহকর্মী-সহমর্মীরা। এরপরও বঙ্গবন্ধু-কন্যাকে হত্যার শেষ প্রচেষ্টা হিসেবে ঘাতকচক্র তার গাড়ি লক্ষ্য করে ১২টি গুলি ছুড়েছিল। সৌভাগ্যবশত ওই গুলিবর্ষণ থেকেও প্রাণে বেঁচে যান বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। তবে এ সময় ঘটনাস্থলে ১৮ জনসহ ২৪ জন নেতাকর্মী নিহত হন। আহত হন পাঁচ শতাধিক। যাদের অনেকেই চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন। কেউ কেউ আজও ফিরে পাননি স্বাভাবিক জীবন। গ্রেনেডের স্পিøন্টারের দুর্বিষহ যন্ত্রণা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন মৃত্যুর দিকে। বঙ্গবন্ধুকন্যা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও তার শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেদিন আওয়ামী লীগ সভাপতিকে আড়াল করে বুলেটের সামনে দাঁড়িয়ে ঘটনাস্থলেই জীবন বিলিয়ে দেন তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকর্মী ল্যান্স করপোরাল (অব.) মাহবুবুর রশীদ। গ্রেনেডের স্পিøন্টারের আঘাতে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকা আওয়ামী লীগের মহিলা সম্পাদিকা এবং রাষ্ট্রপতি প্রয়াত মো. জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমান মারা যান ২৪ আগস্ট। তিনি প্রায় ৫৮ ঘণ্টা মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে মারা যান। আরও নিহত হন আওয়ামী লীগের সহ-সম্পাদক মোস্তাক আহমেদ সেন্টু, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য রফিকুল ইসলাম (আদা চাচা), ঢাকা মহানগরের ৫৮ নম্বর ওয়ার্ড মহিলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সুফিয়া বেগম, ১৫ নম্বর ওয়ার্ড মহিলা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী হাসিনা মমতাজ রীনা, মহিলা আওয়ামী লীগ কর্মী রেজিয়া বেগম, জাতীয় শ্রমিক লীগ কর্মী নাসির উদ্দিন সরদার, ৩০ নম্বর ওয়ার্ড রিকশা শ্রমিক লীগ নেতা মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ হানিফ, ৬৯ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সহসাংগঠনিক সম্পাদক বেলাল হোসেন, যুবলীগ বালুঘাট ইউনিটের সভাপতি ও ক্যান্টনমেন্ট ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সদস্য আবুল কালাম আজাদ, হোসেনপুর ইউনিয়ন যুবলীগ সভাপতি লিটন মুন্সী লিটু, ৮৪ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগ নেতা আতিক সরকার, স্বেচ্ছাসেবক লীগ কর্মী আবদুল কুদ্দুস পাটোয়ারী, নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগ কর্মী ও রি-রোলিং মিল ব্যবসায়ী রতন সিকদার, ছাত্রলীগ কর্মী ও সরকারি কবি নজরুল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মামুন মৃধা, জামালপুর আওয়ামী লীগ কর্মী আমিনুল ইসলাম মোয়াজ্জেম, টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগ কর্মী ইছহাক মিয়া, মো. শামসুদ্দিন, মমিন আলী, আবুল কাসেম ও জাহেদ আলী। এ ছাড়া আরও দু’জনের নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। যাদের পরিচয় মেলেনি। অন্যদিকে গ্রেনেড হামলাকালে শেখ হাসিনাকে ঘিরে মানবঢাল তৈরি করা ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফের মাথায় অসংখ্য স্পিøন্টার বিদ্ধ হয়। প্রায় আড়াই বছর অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ এবং দেশ-বিদেশে চিকিৎসার পর ২০০৬ সালের ২৭ নভেম্বর মারা যান তিনি। গত কয়েক বছরে এই গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত আরও কয়েকজনের মৃত্যু ঘটেছে। সেদিন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা যেন বাঁচতে না পারেন, তার সব চেষ্টাই করেছিল ঘাতকচক্র। সে কারণে তাকে লক্ষ্য করে একাধিক গ্রেনেড ছোড়ার পাশাপাশি তার গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়। এক পর্যায়ে বুলেটের আঘাত গাড়ির চাকা পাংচার করে দেওয়া হয়। যাতে ঘটনাস্থল থেকে বের হতে না পারেন বঙ্গবন্ধু কন্যা। এরপর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার নানাভাবে এ ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেছে। জাতীয় সংসদে এ বিষয়ে কথা বলতে দেওয়া হয়নি তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনাসহ দলের গ্রেনেডাহতদের। উল্টো তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াসহ বিএনপি নেতারা বলেছেন, শেখ হাসিনা ভ্যানিটি ব্যাগে করে সমাবেশস্থলে গ্রেনেড নিয়ে গেছেন। এক পর্যায়ে বিচারপতি মো. জয়নুল আবেদীনকে দিয়ে গঠন করা হয় বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশন। ১ মাস ১০ দিনের মাথায় এই কমিশন ১৬২ পৃষ্ঠার একটি রিপোর্ট সরকারের কাছে জমা দেয়। এরপর আসল ঘটনা ধামাচাপা দিতে শুরু হয় নানা নাটক। তদন্তের গতি ভিন্ন খাতে নিতে শৈবাল সাহা পার্থ নামে এক তরুণকে আটক করে ফাঁসানোর চেষ্টা চলে। মঞ্চস্থ হয় জজ মিয়া নাটক। ২০০৫ সালের ৯ জুন নোয়াখালীর সেনবাগে জজ মিয়াকে আটক করার পর জোর করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করা হয়। এটি সাজানো নাটক প্রমাণ হওয়ার পর থামিয়ে দেওয়া হয় তদন্ত কাজ। এর চার বছর পর ২০০৮ সালের ১১ জুন সবশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে হত্যার অভিযোগ ও বিস্ফোরক আইনে আলাদা দুটি অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি আবদুল হান্নানসহ ২২ জনকে আসামি করা হয়। ওই বছরের ২৯ অক্টোবর অভিযোগ গঠন করে বিচারও শুরু হয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রপক্ষের অধিকতর তদন্তের আবেদন মঞ্জুর করেন ট্রাইব্যুনাল। অধিকতর তদন্তে আসামির তালিকায় নাম আসে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ আরও ৩০ জনের। তারেকসহ ১৮ জনকে পলাতক দেখিয়ে বিচার শুরু হয়। বিচারকাজ চলার সময়ই অন্য মামলায় জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল, মানবতাবিরোধী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি আব্দুল হান্নান ও শরীফ শাহেদুল আলমের ফাঁসি কার্যকর হয়। ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর মামলার রায়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, খালেদা জিয়ার তৎকালীন রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, সাবেক এমপি কাজী মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেন দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১। আর সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, তার ভাই জঙ্গি নেতা মাওলানা তাজউদ্দিনসহ ১৯ জনের মৃত্যুদন্ড দেন আদালত। মামলার আসামি সাবেক পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তাসহ ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। আসামিদের মধ্যে কারাগারে আছেন ২৭ জন। ১৪ জন পলাতক। জামিনে আছেন ৯ জন।
দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। বাণীতে তারা ২১ আগস্টের শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা ও আহতদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন। এদিকে মানব ইতিহাসের এই জঘন্য হত্যাকান্ডের ভয়াল এই দিন স্মরণে বিস্তারিত কর্মসূচি হাতে নিয়েছে আওয়ামী লীগ। গ্রেনেড হামলার প্রতিবাদ ও নিহতদের স্মরণে আজ সোমবার অনুষ্ঠেয় কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে বেলা ১১টায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে নির্মিত বেদিতে শ্রদ্ধা নিবেদন, সোয়া ১১টায় আলোচনা সভা। সভায় সভাপতিত্ব করবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। রোববার আওয়ামী লীগের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ কর্মসূচির ঘোষণা দেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।