স্টাফ রিপোর্টার: আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রশ্ন রেখে বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাত করা এতই সোজা? এটা আওয়ামী লীগ পারে। আইয়ুব খানকে উৎখাত করেছি, ইয়াহিয়া খানকে যুদ্ধে পরাজিত করে উৎখাত করেছি। জিয়াকে পাই নাই হাতে। কিন্তু জিয়া যেখানেই গেছে আন্দোলন তার বিরুদ্ধে হয়েছে, এরশাদকে উৎখাত করেছি। খালেদা জিয়া ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোট চুরি করে, তাকে উৎখাত করা হয়েছে। আবার ২০০৬ সালে ১ কোটি ২৩ লাখ ভুয়া ভোটার দিয়ে নির্বাচন করতে চেয়েছিলো সেটাও বাতিল হয়েছে। কাজেই আওয়ামী লীগ পারে। আন্দোলন করে আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাত করা এত সোজা নয়।
গতকাল রাজধানীর খামারবাড়ীর বাংলাদেশ কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে আওয়ামী লীগ আয়োজিত বিজয় দিবসের আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। এ সময় দেশকে ধ্বংস করার জন্য খুনী ও যুদ্ধাপরাধীরা যেনো আবার ক্ষমতায় আসতে না পারে সেজন্য জনগণকে সতর্ক থাকার আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় বসলে তারা চক্রান্ত করতে পারবে, ষড়যন্ত্র করতে পারবে যেমন ২০০১ সালে চক্রান্ত করে আমাদের ক্ষমতায় আসতে দেয়নি তার ভোগান্তি এ দেশের মানুষের হয়েছে। বিজয় আমরা এনেছি, এই বিজয়ের পতাকা সমুন্নত করেই চলতে হবে। আবার যেনো ওই খুনী, যুদ্ধাপরাধী, যাদের আমরা বিচার করেছি, তারা ক্ষমতায় এসে এ দেশকে ধ্বংস করতে না পারে।
শেখ হাসিনা আক্ষেপ করে বলেন, আওয়ামী লীগের অপরাধটা কী? আওয়ামী লীগতো ক্ষমতায় বসে নিজে খাচ্ছে না, আওয়ামী লীগ তো দেশের মানুষকে খাওয়াচ্ছে। গৃহহীন-ভূমিহীন মানুষকে ঘর দিচ্ছি। সংবিধানে বর্ণিত মানুষের প্রতিটি মৌলিক চাহিদা আমরা পূরণ করে যাচ্ছি। তিনি আরো বলেন, বিএনপি বিজয়ের মাসে বিজয় উৎসব না করে যেদিন থেকে পাকিস্তানি বাহিনী দেশে বুদ্ধিজীবী হত্যা শুরু করে সেদিন ঘোষণা দেয় যে সরকার উৎখাত করবে। তাই মানুষকেও সজাগ থাকতে হবে।
আওয়ামী লীগ প্রধান বলেন, দেশটাকে অর্থনৈতিকভাবে সম্পূর্ণ পঙ্গু করার এবং মুক্তিযদ্ধের চেতনাকে বিপথে ঠেলে দেয়ার ষড়যন্ত্রই এ দেশে ’৭৫ পরবর্তী সরকারগুলো করেছে। ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ সরকারের এসেছে কিন্তু সেই ক্ষমতায় আসাটা অত্যন্ত দুরুহ ছিলো। জনগণ আমাদের সমর্থন করে, ভোট আমাদের আছে কিন্তু নির্বাচনে কারচুপি করে হোক, ষড়যন্ত্র করে হোক, চক্রান্ত করে হোক বার বার আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসতে বাধা দেয়া হয়েছে।
বিএনপির সাথে বামপন্থীদের যুগপৎ আন্দোলনের কড়া সমালোচনা করে আওয়ামী লীগ প্রধান বলেন, বিএনপি-জামায়াতসহ আরো কিছু পার্টি মিলে দাঁড়াল, কিন্তু আরেকটি জিনিস খুব অবাক লাগে কোথায় লেফটিস্ট আর কোথায় রাইটিস্ট। যারা লেফটিস্ট তারা মনে হলো ৯০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়েছে। অর্থাৎ সেই জামায়াত-বিএনপি, তাদের সাথে আমাদের বাম, অতি বাম, স্বল্প বাম, তীব্র বাম, কঠিন বাম সব যেন এক হয়ে এক প্লাটফর্মে। ‘সত্যি সেলুকাস কী বিচিত্র এ দেশ!’ সে কথাই মনে হয়, কোথায় তাদের নীতি আর আদর্শ, কোথায় কী। তিনি বলেন, কী কারণে যারা হত্যাকারী, ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাকারবারি করে সাজাপ্রাপ্ত আসামি, গ্রেনেড হামলা করে আইভি রহমানসহ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী হত্যার বিচারের রায়ে সাজাপ্রাপ্ত আসামি, মানি লন্ডারিংয়ের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত, এতিমের অর্থ আত্মস্যাৎ করে যে দলের প্রধান সাজাপ্রাপ্ত আসামি তাদের নেতৃত্বে এত বড় বড় তাত্ত্বিক এত বড় বড় কথা বলে, এত কিছু করে তারা এক হয়ে যায় কিভাবে! সেটাই আমার প্রশ্ন।
বিএনপি স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনীতিতে পুনর্বাসন করেছিল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সেই দলে যুক্ত হয়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে হটাতে হবে? আর ১০ ডিসেম্বর যেদিন আমাদের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা শুরু করলো, ১৪ তারিখ পর্যন্ত সমানে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করলো। এদের সাথে হাত মিলিয়ে তাদের সমর্থন করে কিভাবে? এটা ভাবলে আমার অবাক লাগে। এরাতো ইতিহাস জানে। মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন জানানো বিদেশীদের সম্মাননা দেয়ার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের জন্য এতটুকু কেউ করলে আমরা সেটা স্বীকার করি। আবার কেউ আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করলে এর প্রতিবাদও আমরা করতে জানি।
আমদানি ব্যয় বাড়ায় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বে দাম বাড়লে আমাদের কী করার আছে। এ সময় তিনি ভর্তুকি মূল্যে বিদ্যুৎ-গ্যাস দেয়া আর সম্ভব নয় বলে জানান। শেখ হাসিনা বলেন, এত দিন আমাদের অর্থ ছিলো, আমরা ভর্তুকি দিয়েছি। কিন্তু করোনা মহামারী এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং অবরোধের ফলে বিশ্বব্যাপী যে মন্দা দেখা দিয়েছে তাতে আমরাও আক্রান্ত। সুতরাং এতদিন বিদ্যুৎ ও গ্যাসে যে ভর্তুকি দেয়া হয়েছে সেই ভর্তুকির টাকা এখন আপনাদের দিতে হবে।
সভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সূচনা বক্তব্য দেন। দলের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আব্দুস সোবহান গোলাপ এবং উপপ্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিনের সঞ্চালনায় সভায় আরো বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু, সভাপতিম-লীর সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক ও সিমিন হোসেন রিমি, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস, ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. হুমায়ুন কবির প্রমুখ।
এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দেশে যে ‘বিচারহীনতার সংস্কৃতি’ চালু হয়েছিল তা যেন আবার ফিরে আসতে না পারে, সেজন্য সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। গতকাল বিকেলে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট প্রতিষ্ঠার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি চাই, আমাদের মতো কেউ যেন আর বিচারহীনতার (ইনডেমনিটি) কষ্ট না পায়, বাবা-মা-ভাই মারা গেল তার বিচার চাইতে পারব না আবার তাদেরকেই গণতন্ত্রের ধারক ও বাহক বলা হয় এটা সত্যিই দেশের জন্য, জাতির জন্য, স্বাধীনতার জন্য, একটা স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক। প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিচারপতি ওবায়দুল হাসান স্বাগত বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক। বিশেষ অতিথি ছিলেন ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি মুকেশ কুমার রশিক ভাই শাহ এবং বাংলাদেশ আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক।
প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান ও বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ৫০ টাকার স্মারক নোট এবং স্মারক ডাকটিকিট অবমুক্ত করেন। তিনি ৫০ বছরের পথ চলায় সুপ্রিম কোর্ট এবং বাংলাদেশের সংবিধানের ইংরেজি কপির মোড়ক উন্মোচন করেন। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী নিম্ন আদালতের বিচারকদের মধ্যে ছয়টি ক্যাটাগরিতে এই প্রথমবারের মতো প্রবর্তিত প্রধান বিচারপতি পদক (পুরস্কার) তুলে দেন। পাঁচটি ক্যাটাগরিতে বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা তথা নিম্ন আদালতের বিচারকদের ‘প্রধান বিচারপতি পদক’ দেয়া হয়েছে। আর দলগতভাবে এ পদক পেয়েছেন ময়মনসিংহ জেলা ও দায়রা জজ আদালত।
ব্যক্তিগতভাবে পদকপ্রাপ্ত পাঁচ ক্যাটাগরির বিচারক হলেন- জেলা ও দায়রা জজ ক্যাটাগরিতে চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ বেগম জেবুন্নেছা, অতিরিক্ত জেলা জজ ক্যাটাগরিতে টাঙ্গাইলের চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সউদ হাসান, যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ ক্যাটাগরিতে নওগাঁর যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ মো. খোরশেদ আলম, সিনিয়র সহকারী জজ ক্যাটাগরিতে চট্টগ্রামের সিনিয়র সহকারী জজ মোসা. রেশমা খাতুন এবং সহকারী জজ ক্যাটাগরিতে রংপুরের সহকারী জজ মো. হাসিনুর রহমান মিলন। আর দলগতভাবে পদকপ্রাপ্ত জেলা হলো-ময়মনসিংহ জেলা ও দায়রা জজ। এ জেলার পক্ষে জেলা ও দায়রা জজ হেলাল উদ্দিন পদক গ্রহণ করেন।
ব্যক্তিগতভাবে পদকপ্রাপ্ত প্রত্যেককে ২২ ক্যারেট ১৬ গ্রাম স্বর্ণের পদক এবং দুই লাখ টাকার চেক এবং ময়মনসিংহ জেলাকে ২২ ক্যারেট ১৬ গ্রাম স্বর্ণের পদক এবং ৫ লাখ টাকার চেক দেয়া হয়েছে।