মাথাভাঙ্গা অনলাইন: বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগরের উপকূলীয় বিভিন্ন দেশে এ পর্যন্ত ৬৩টি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে। ৬৪তম ঘূর্ণিঝড় পর্যন্ত নাম ঠিক করেছে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও)। এর নাম হবে ‘আমপান’। ৬৫তম ঘূর্ণিঝড়ের নাম কী হবে? এ জন্য ডব্লিউএমও আঞ্চলিক আবহাওয়া সংস্থা আরএসএমসির কাছে নামের তালিকা চেয়েছে। এই অঞ্চলে আরএসএমসির সদস্য বাংলাদেশসহ ১৩ দেশ। এসব দেশের প্রতিটির ১৩টি করে দেওয়া মোট ১৬৯টি নাম থেকে বাছাই করা হবে এ অঞ্চলের ৬৫তম ঘূর্ণিঝড়ের নাম। ৫০ বছর আগে, ১৯৭০ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়। সে ঘটনার কথা উঠলেই মনে পড়ে যাবে দেশের উপকূলে অসংখ্য লাশ ভেসে থাকার মর্মান্তিক দৃশ্য। ১০ থেকে ৩৩ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে ৫ লাখ মানুষের সঙ্গে প্রাণ হারায় অসংখ্য গবাদিপশু। ভেসে যায় বহু ঘরবাড়ি। প্রায় ২১ বছর পর ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল ঘণ্টায় ২২৫ কিলোমিটার বেগে আঘাত হানে আরেকটি ঘূর্ণিঝড়। প্রাণ হারায় দেড় লাখ মানুষ। এরপর একের পর এক ঘূর্ণিঝড় ছোবল দিয়েছে এ দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে। কিন্তু ১৯৭০ বা ১৯৯১ সালের মতো নামবিহীনভাবে এসব ঘূর্ণিঝড়ের ঝাপটা এসে পড়েনি। কখনো নাম ছিলো ‘মহাসেন’, কোনোটির নাম ছিলো ‘মোরা’। সবশেষ ২০১৯ সালে ‘ফণী’ নামে ঘূর্ণিঝড় বেশ দাপট নিয়ে এগিয়ে এলেও সুন্দরবনের বাধার মুখে পড়ে বৃষ্টি ঝরাতে ঝরাতে দুর্বল হয়ে প্রকৃতির কাছে আত্মসমর্পণ করে। কিন্তু নাম ধারণ করে প্রথম কোনো ঘূর্ণিঝড়টি বাংলাদেশে ভয়াবহ আঘাত হেনেছিলো?
আবহাওয়া অধিদপ্তরের নামটি জানার পর তা যেন মনের গভীরে আঁচড় কেটে দেয়। তিন অক্ষরের নাম তার—‘সিডর’। ১৩ বছর আগে এই ‘সিডর’ ছিলো এ দেশে নাম ধারণ করে আসা প্রথম ঘূর্ণিঝড়। আগামী দিনগুলোয় বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগর থেকে উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানতে পারে, তেমন ১৬৯টি ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করেছে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও)। বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগরে ঘূর্ণিঝড়ের ১৬৯ নামের তালিকা চূড়ান্ত করেছে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা এই অঞ্চলে বিশেষ আঞ্চলিক আবহাওয়া সংস্থার (আরএসএমসি) ১৩টি দেশ নামগুলো দিয়েছে। ১৩ বছর আগে ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর দেশের দক্ষিণে খুলনা-বরিশাল উপকূলে আঘাত হানা প্রবল এই ঘূর্ণিঝড়ের বাতাসের গতি ছিলো ২২৩ কিলোমিটার। এ সময় জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ছিলো ১৫ থেকে ২০ ফুট। গতিবেগে সিডর ছিলো সেই ১৯৭০ বা ১৯৯১ সালের নামবিহীন ঘূর্ণিঝড়ের মতো। তবে প্রশ্ন জাগতে পারে, ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ কবে থেকে শুরু হয়?
আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা জানান, সময়টা বেশি দিন আগের নয়। মাত্র ১৬ বছর আগে, ২০০৪ সাল থেকে ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ হতে থাকে। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার (ডব্লিউএমও) অনুমোদন নিয়ে বিশ্বের ছয়টি বিশেষ আঞ্চলিক আবহাওয়া সংস্থা (আরএসএমসি) ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণের কাজ শুরু করে। বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগর অঞ্চলে আরএসএমসি ২০০৪ সালে প্রথমবারের মতো ৬৪টি ঘূর্ণিঝড়ের নামের তালিকা করেছিলো। এরপর ৬৩টি ঘূর্ণিঝড় বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগরের উপকূলীয় বিভিন্ন দেশে আঘাত হেনেছে। এর কোনোটি ছিলো দুর্বল, আবার কোনোটি প্রচণ্ড শক্তিশালী। ১৬ বছর আগের তালিকায় থাকা ৬৪ নম্বর ঘূর্ণিঝড়ের নাম হবে ‘আমপান’। এটি থাইল্যান্ডের দেয়া নাম। আরব ও বঙ্গোপসাগরে এখন যে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হবে, তার নাম হবে ‘আমপান’। এরপরই ১৬৯টি ঘূর্ণিঝড়ের নামের তালিকা থেকে নামকরণ শুরু হবে।
ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ কেন: নামবিহীন থাকলে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড়ের শক্তি, ধরণ সম্পর্কে তথ্য দ্রুত জানা যায় না। এর আঘাত হানার সময় বা তারিখ বের করে পরবর্তী সময়ে সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড়ের গতিপ্রকৃতি নির্ণয় করতে হয় আবহাওয়াবিদদের। এটি বেশ সময়সাপেক্ষ। ডব্লিউএমও সে জন্য ছয়টি বিশেষ আঞ্চলিক আবহাওয়া সংস্থার (আরএসএমসি) সঙ্গে সমন্বয় করে ২০০৪ সাল থেকে ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ শুরু করেছে। আরএসএমসি তার সদস্য দেশগুলোর কাছ থেকে নামের তালিকা চেয়ে থাকে। তালিকা পেলে দীর্ঘ সময় যাচাই-বাছাই করে সংক্ষিপ্ত তালিকা করে ডব্লিউএমওর কাছে পাঠায়। ডব্লিউএমও চলতি এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সম্ভাব্য ১৬৯টি ঘূর্ণিঝড়ের নামের তালিকার অনুমোদন দিয়েছে। এই তালিকা ২২ এপ্রিল ডব্লিউএমও ও বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগরের আরএসএমসির সদস্য দেশগুলোর কাছে পাঠানো হয়। এই অঞ্চলে আরএসএমসির সদস্য রয়েছে বাংলাদেশসহ ১৩ দেশ। বাকি ১২ দেশ হলো ভারত, ইরান, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, ওমান, পাকিস্তান, কাতার, সৌদি আরব, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, আরব আমিরাত ও ইয়েমেন। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে সমন্বয়কারী হলেন আবহাওয়াবিদ আবদুল মান্নান।
আবদুল মান্নান বলেন, কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যক্তি বা বর্ণ দিয়ে ঘূর্ণিঝড়ের নাম দেয়া হয় না। ঘূর্ণিঝড়ের নাম থাকলে এটি সহজে শনাক্ত করা যায়। যে এলাকায় বা অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়টি আঘাত হানতে যাচ্ছে, সেখানকার লোকজন সচেতন হয়ে যায়। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ঘূর্ণিঝড়টি সম্পর্কে গুরুত্ব বাড়ে। ফলে দ্রুত সতর্ক বার্তা পৌঁছানো সম্ভব হয়। আবদুল মান্নান আরও বলেন, রাজনৈতিক, সামাজিকসহ কোনো ধর্মীয় গোষ্ঠীর অনুভূতিতে আঘাত হানতে পারে, এমন কোনো নাম ঘূর্ণিঝড়কে করা হয় না। ২০১৬ সালে ঘূর্ণিঝড় ‘মহাসেন’ ছিলো শ্রীলঙ্কার এক রাজার নামে। এ নাম শ্রীলঙ্কা দেয়ায় পর তারা দুঃখ প্রকাশ করেছিলো। এরপর প্রকৃতি, আবহাওয়া ও জলবায়ুর সঙ্গে সংগতিপূর্ণ এমন নামে ঘূর্ণিঝড়ের নাম দেয়া হচ্ছে। সাগরে সৃষ্টি হওয়া লঘুচাপ প্রথমে নিম্নচাপে পরিণত হয়। শক্তিশালী হয়ে উঠলে নিম্নচাপটি এরপর ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়। তখনই তালিকায় আগে থেকে নির্ধারণ করে রাখা একটি নাম দেয়া হয়ে থাকে ঘূর্ণিঝড়টির। কোনো নামেরই পুনরাবৃত্তি করা হয় না।
জানা গেছে, আরএসএমসির সদস্য দেশগুলোর নামের ক্রমানুসারে নতুন ঘূর্ণিঝড়ের নামের তালিকা করা হয়েছে। প্রতিটি দেশ থেকে ১৩ করে নাম নিয়ে মোট ১৬৯ ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ হয়েছে। ২০০৪ সালে বাংলাদেশের দেওয়া ‘অনিল’ নামে প্রথম ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ হয়েছিলো। এই ঘূর্ণিঝড় ভারতে আঘাত করেছিলো। বাংলাদেশে আঘাত হানা নামকরণ হওয়া প্রথম ঘূর্ণিঝড়টি ছিলো ‘সিডর’। এটি ছিল ওমানের দেওয়া নাম।
নতুন ঘূর্ণিঝড়ের জন্য পাঠানো ১৬৯ নাম
বাংলাদেশ: নিসর্গ, বিপর্যয়, অর্ণব, উপকূল, বর্ষণ, রজনী, নিশীথ, ঊর্মি, মেঘলা, সমীরণ, প্রতিকূল, সরবর, মহানিশা।
ভারত: গাতি, তেজ, মুরাসু, আগ, ভায়ুম, ঝড়, প্রবাহ, নীড়, প্রভানজান, ঘূর্ণি, আমবুদ, জালাদি, ভিগা।
ইরান: নিভার, হামুন, আগভান, সিপান্দ, বুরান, আনাহিতা, আজআর, পোয়ান, আরশাম, হেনজামি, সাভাস, তাহামতান, তুফান।
মালদ্বীপ: বুরিভি, মিদহিল, কানি, ওডি, কিনাউ, এন্ধেরি, রিয়াউ, গুরুভা, কুবাংগি, হোরাংগু, থুনডি, ফানা।
মিয়ানমার: তুয়াতি, মিগজায়ুম, নাগামান, কাজাথি, যাবাগজি, ইউয়ুম, মউইহু, কাউই, পিংকু, জিনগাউন, লিনইওনি,কাইকান, বাউপা।
ওমান: ইয়াস, রিমাল, সাইল, নাসিম, মুথন, সাদিম, দিমা, মানজর, রুকাম, ওয়াতাদ, আল-জারয, রাবাব, রাদ।
পাকিস্তান: গুলাব, আসনা, সাহাব, আফসান, মানাহিল, সুজানা, পারওয়ায, জান্নাতা, সারসার, বাদবান, সাররাব, গুলনার, ওয়াসেক।
কাতার: শাহীন, ডানা, লুলু, মউজ, সুহাইল, সাদাফ, রিম, রায়হান, আনবার, ওউদ, বাহার, সাফ, ফানার।
সৌদি আরব: জাওয়াদ, ফেনগাল, ঘাজির, আসিফ, সিদরাহ, হারিদ, ফাইদ, কাসির, নাখিল, হাবুব, বারেক, আরিম, ওয়াবিল।
শ্রীলঙ্কা: আসানি, শাক্তি, জিগুম, গগনা, ভারামভা, গাজানা, নিবা, নিনাদা, ভিদুলি, ওঝা, সালিথা, রিভি, রুদু।
থাইল্যান্ড: সিতারাংগ, মনথা, থিয়ানুট, বুলান, ফুতালা, আইয়ারা, সামিংগ, কারইসন, মাতচা, মাহিংসা, ফারিওয়া, আাসুরি, থারা।
আরব আমিরাত: মানদউস, সেনইয়ার, আফুর, নাহ-হাম, কুফফাল, দামান, দিম, গারগুর, খুব, দিগল, আথমাদ, বুম, সাফার।
ইয়েমেন: ব্রম, শুকরা, ফারতাক, দারসাহ, সামহাহ, বাকহুর, ঘাওয়েযি, হাউফ, বালহাফ, মোকহা, দিতওয়াহ, দিকসাম, সিরা।