স্টাফ রিপোর্টার: রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলোর মধ্যে একমাত্র লাভজনক প্রতিষ্ঠান চুয়াডাঙ্গার দর্শনায় অবস্থিত কেরু অ্যান্ড কোম্পানি (বাংলাদেশ) লিমিটেড। এটি একটি সমন্বিত কারখানা। এখানে চিনি, ভিনেগার, হ্যান্ড স্যানিটাইজারসহ বিভিন্ন ধরনের স্পিরিট ও দেশি-বিদেশি মদ উৎপাদন করা হয়। মূল পণ্য চিনি হলেও কোম্পানিকে বাঁচিয়ে রেখেছে ডিস্টিলারি পণ্য মদ। সেই লাভের খাতে নজর পড়েছে সংঘবদ্ধ চোর চক্রের। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে চোরাই মদসহ একের পর এক গ্রেফতারের ঘটনা ঘটলেও কেরু প্রশাসন চুরি ঠেকাতে অনেকটাই নির্বিকার। সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অভিযানে এই কারাখানায় উৎপাদিত দেশি মদ ও বিলাতি মদসহ (ফরেন লিকার) একাধিক চালান ধরা পড়েছে। এমনকি বোতলভর্তি বিলাতি মদ, মদের বোতলের লেবেল ও খালি বোতল উদ্ধারের ঘটনাও ঘটেছে। গ্রেফতার করা হয়েছে কেরুর শ্রমিকদের। অভিযোগ রয়েছে, মদ চুরিতে জড়িত শ্রমিকেরা সিবিএর সাবেক ও বর্তমান নেতাদের ঘনিষ্ঠজন হওয়ায় শাস্তির বাইরে থেকে যাচ্ছেন। রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলোর মধ্যে একমাত্র লাভজনক প্রতিষ্ঠান হওয়ায় কর্মকর্তাদের পছন্দের কর্মস্থল কেরু। চুরিতে জড়িত শ্রমিকদের বিরুদ্ধে কর্মকর্তারা কঠোর অবস্থান নিলে সিবিএ নেতাদের চাপের মুখে তা থেকে সরে আসেন। সর্বশেষ ২৩ অক্টোবর রাতে চুয়াডাঙ্গার লোকনাথপুরে ডিবির তল্লাশির মুখে পড়ে কেরুর একটি কাভার্ড ভ্যান। বগুড়ার সান্তাহার পণ্যাগারে (ওয়্যারহাউস) মদের চালান নামিয়ে দর্শনায় ফিরছিলো সেটি। এ সময় কাভার্ড ভ্যানটিতে ১০ লিটার দেশি মদ পায় ডিবি। এই মদ ব্যারেল থেকে চুরি করেছিলেন চালক মনিরুল ইসলাম ও তার দুই সহকারী। তাদের আটক করে দামুড়হুদা মডেল থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করে ডিবি। কাভার্ড ভ্যানটি জব্দ করা হয়। এর আগে ৩১ আগস্ট কেরুর প্রধান ফটক থেকে ১০০ লিটার দেশি মদসহ ট্রাকচালক সাইফুল ইসলাম ও তার দুজন সহকারীকে দর্শনা থানা-পুলিশ গ্রেফতার করে। বরিশাল পণ্যাগারে পরিবহনকালে তারা এই বিপুল পরিমাণ মদ চুরি করেছিলেন। সেখান থেকে ফিরে পাচারকালে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। সরেজমিনে শ্রমিক-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কোম্পানি থেকে দেশের বিভিন্ন পণ্যাগারে দেশি মদ পরিবহনের সময় তা চুরি ও পাচারের অভিযোগে চালকসহ শ্রমিক গ্রেফতারের একাধিক ঘটনা যেমন আছে, তেমনি ডিস্টিলারি থেকে বিলাতি মদ চুরির ঘটনাও কম নয়। ৯ ফেব্রুয়ারি চার বোতল বিলেতি মদসহ পরিবহন বিভাগের চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক রকি হোসেন নিরাপত্তাকর্মীদের হাতে ধরা পড়েন। সিবিএ নেতার ঘনিষ্ঠজন হওয়ায় তাকে সে সময় মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। কেরু প্রশাসন রকির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা দিলেও তা কার্যকর করেনি। ১৬ জুলাই আবারও রকি চার বোতল মদ চুরি করে কোম্পানির ফটকেই ধরা পড়েন। এ দফায় মুচলেকা ছাড়াই তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। ১৫ জুলাই দর্শনা থানা-পুলিশ রামনগর থেকে ৪০ লিটার দেশি মদসহ বাদল শেখ নামের এক মাদক ব্যবসায়ীকে আটক করে। বাদল দাবি করেন, কেরুর শ্রমিক জুলফিকার হোসেনসহ তিনজন ওই মদের মালিক। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর জুলফিকারকে জুন মাসে ২০ লিটার বাংলা মদসহ আটক করে। ভ্রাম্যমাণ আদালত তাকে সে সময় ১৫ দিনের বিনাশ্রম কারাদ- দিয়েছিলেন। সংঘবদ্ধ চোরচক্র ১৩ আগস্ট রাতে ডিস্টিলারির গুদামের ভেন্টিলেটর দিয়ে ১৩ নম্বর ভ্যাটে (মদ রক্ষণাগার) পাইপ লাগিয়ে দেশি মদ চুরির চেষ্টা করে। কেরুজ শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি সবুজ আহমেদের ভাষ্যমতে, ওই দিন ভ্যাটে কম মদ থাকায় নাগাল পায়নি চোরেরা। এ ঘটনায় কারখানার ব্যবস্থাপক (হিসাব) গোলাম জাকারিয়াকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত শেষে তিনি জানান, ভ্যাট থেকে কোনো মদ চুরি হয়নি। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ১৬ ফেব্রুয়ারি দর্শনা পৌর এলাকার আনোয়ারপুরে অভিযান চালিয়ে কেরুর তৈরি ৭৫০ মিলিলিটার পরিমাপের সাত বোতল বিলাতি মদসহ আমিনুল ইসলাম ও জাহিদ হোসেন নামের দুজনকে আটক করে। আটক দুজনই দাবি করেন, কেরুর শ্রমিক-কর্মচারীদের মাধ্যমে এই মদ ডিস্টিলারি থেকে তারা সংগ্রহ করেছেন। চুরির বিষয়টি অস্বীকার কর্তৃপক্ষের অনুসন্ধানে জানা গেছে, কোম্পানি থেকে পণ্যাগারগুলোতে দেশি মদ পাঠানোর সময় ব্যারেলের মুখে যে নিরাপত্তা সিল লাগানো হয়, গাড়িতে পরিবহনের সময় চালক ও সহকারীরা সেটি খুলে মদ বের করে নেন। এরপর আগে থেকে সংগ্রহ করা সিল লাগিয়ে দেন। মদ চুরি বন্ধে পণ্যাগার থেকে ফেরা পরিবহন কোম্পানির পক্ষ থেকে এর আগে তল্লাশি চালানো এবং চোরাই মদ উদ্ধার করা হলেও নানামুখী চাপে তা বন্ধ হয়ে গেছে। একের পর এক চুরি নিয়ে সম্প্রতি কথা হয় মহাব্যবস্থাপকের (ডিস্টিলারি) অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা ব্যবস্থাপক (ফরেন লিকার) রাজিবুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি দাবি করেন, ডিস্টিলারি থেকে অবৈধভাবে মদ বের করার কোনো সুযোগ নেই। ফটকসহ গোটা ডিস্টিলারিতে তিন স্তরের নিরাপত্তা রয়েছে। তা ছাড়া বোতলগুলো আকারে বড় হওয়ায় তা লুকিয়ে বের করাও সম্ভব না। কেরুজ শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মাসুদুর রহমান বলেন, ‘মদ পরিবহনে নিয়োজিত শ্রমিকেরা দীর্ঘদিন ধরে কিছুটা সুবিধা পেয়ে থাকেন। তবে ২৩ অক্টোবর কাভার্ড ভ্যানে তল্লাশি চালিয়ে মদসহ যাদের আটক দেখানো হয়েছে, খোঁজ নিয়ে জেনেছি, তাদের কাছে ওই সময় কোনো মদ ছিলো না। তবে ৩১ আগস্ট ১০০ লিটার মদসহ যে তিনজনকে পুলিশ আটক করেছে, সে ঘটনায় দ্বিমত নেই।’ কেরুর মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) ইউসুফ আলী দাবি করেন, দর্শনা থেকে যে পরিমাণ দেশি মদ পাঠানো হয়েছিল, সান্তাহার পণ্যাগারের ইনচার্জ আবদুস সামাদ চালানের কাগজ অনুযায়ী তা বুঝে পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন। চালকের কাছে থাকা মদের উৎস বিষয়ে জানা নেই। ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন বলেন, পণ্যাগারে মদ পাঠানোর সময় ব্যারেল সিলগালা করে দেয়া হয়। নিয়মানুযায়ী, পণ্যাগার কর্তৃপক্ষ সিলগালাসহ পণ্য বুঝে নেন এবং পাঠানো হিসাব অনুযায়ী মূল্য ও কাস্টমস ডিউটি পরিশোধ করা হয়ে থাকে। তারপরও চালকদের কাছে মদ কোথা থেকে আসে, তা ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.