স্টাফ রিপোর্টার: দেশের কৃষি বিভাগের সব সেক্টরে আধুনিকায়নের ছোঁয়া লাগলেও পিছিয়ে আখ চাষ। সরকার দেশীয় কৃষির সব বিভাগে উন্নয়ন করতে ভর্তুকিসহ নানা পদক্ষেপ নিলেও চিনিকলগুলো যেন অবহেলিত রয়ে গেছে। ফলে বহুমুখী সংকট আর সমস্যা নিয়ে চলছে ঝিনাইদহের মোবারকগঞ্জ চিনিকল। সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৬৭ কোটি ৫৮ লাখ ৩৪ হাজার টাকা খরচের বিপরীতে আয় হয় ৭১ কোটি ৮ লাখ ৪৬ হাজার টাকা। এই সময়ে প্রতি কেজি চিনি উৎপাদন খরচ পড়ে ঋণের সুদসহ ২০৬ টাকা ৪৮ পয়সা। তবে সেই চিনি বিক্রি হচ্ছে ৭৫ টাকায়। মিলের শ্রমিকরা বলছেন, মান্ধাতার আমলের কারখানায় উৎপাদন হচ্ছে চিনি। দীর্ঘদিনের জমে থাকা মোটা অংকের ঋণের সুদ যেন মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে বছরের পর বছর দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের এ বৃহৎ ভারী শিল্পকে মোটা অংকের লোকসান গুনতে হচ্ছে।
তবে মিলের প্রধান কর্মকর্তা বলছেন, লোকসান তো কৃষির সব সেক্টরে হতে পারে বা হয়। লোকসান কমিয়ে লাভের মুখ দেখতে হলে কারখানার যন্ত্রপাতির আধুনিকায়ন, ঋণ ও সুদ মওকুফ, আখের জাত উন্নয়ন ও বিকল্প শিল্প কারখানা গড়ে তুলতে হবে। জানা গেছে, ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলা শহরে ১৯৬৫ সালে ৩ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০৭ দশমিক ৯৩ একর নিজস্ব জমির ওপর নেদারল্যান্ডস সরকারের সহযোগিতায় মোবারকগঞ্জ চিনিকলটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর মধ্যে ২০ দশমিক ৬২ একর জমিতে কারখানা, ৩৮ দশমিক ২২ একর জমিতে কর্মকর্তা ও শ্রমিক-কর্মচারীদের জন্য আবাসিক কলোনি, ২৩ দশমিক ৯৮ একর পুকুর এবং ১০৭ একর জমিতে পরীক্ষাম‚লক ইক্ষু খামার করা হয়। এছাড়া ১৮ দশমিক ১২ একর জমিজুড়ে রয়েছে সাবজোন অফিস ও আখ ক্রয়কেন্দ্র। প্রতিষ্ঠাকালীন মৌসুমে পরীক্ষাম‚লকভাবে ৬০ কর্মদিবস আখ মাড়াই চলে। লক্ষ্যপ‚রণ হওয়ায় ১৯৬৭-৬৮ মাড়াই মৌসুম থেকে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয়। ঝিনাইদহের ছয় উপজেলা ছাড়াও যশোরের দুটি উপজেলা নিয়ে গঠিত মিলে আটটি জোনের আওতায় চাষযোগ্য জমির পরিমাণ সাড়ে তিন লাখ একর। আখ ক্রয়কেন্দ্র রয়েছে ৪৮টি।
মিল সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আখের দামে বৈষম্য, বিক্রয় শর্তের জটিলতা ও চিনির লালচে রঙের কারণে গ্রাহক ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে আগ্রহ নিম্নমুখী। অন্যদিকে আখের জাত উন্নয়ন না হওয়ায় চিনি আহরণের হার কম। ফলে বছরের পর বছর ঐতিহ্যবাহী এ মিলটি মোটা অংকের লোকসানের মুখোমুখি হচ্ছে। অন্যদিকে, চিনি উৎপাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ের শ্রমিকদের মজুরি খরচ, আখ ক্রয়, পরিবহন খরচ, কারখানা মেরামত এবং বয়লারের জ্বালানিসহ অর্ধশতাধিক খাতের খরচ মিটিয়ে প্রতি বছরই বাড়ছে চিনি উৎপাদন খরচ। সে তুলনায় বাড়ছে না চিনির দাম। এদিকে ব্রিটিশ আমলের যন্ত্রাংশে মেরামতসহ ব্যবস্থাপনা বাবদ প্রতি বছরই বাড়ছে জ্বালানিসহ অন্যান্য খরচ। বর্তমানে মিলে ১ হাজার ১৮৪ পদের বিপরীতে কর্মকর্তা-কর্মচারী ৬৭৯ জন।
চিনিকলের আয় ও খরচের হিসাব থেকে জানা যায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৯৪ কোটি ৮৯ লাখ ৯ হাজার টাকা খরচের বিপরীতে আয় হয় ৫৯ কোটি ২৫ লাখ ৩১ হাজার টাকা, এই সময়ে ঋণের সুদসহ প্রতি কেজি চিনি উৎপাদনে খরচ পড়ে ১৭৫ টাকা ৫৮ পয়সা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১০৫ কোটি ৮৬ লাখ ৪৬ হাজার টাকা খরচের বিপরীতে আয় হয় ৪১ কোটি ৫৪ লাখ ৮৮ হাজার টাকা, এই সময়ে প্রতি কেজি চিনি উৎপাদন খরচ পড়ে ঋণের সুদসহ ১৯২ টাকা ৪৫ পয়সা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৩০ কোটি ৪২ লাখ ৫ হাজার টাকা খরচের বিপরীতে আয় হয় ৩৮ কোটি ৩৩ লাখ ৬২ হাজার টাকা এবং প্রতি কেজি চিনি উৎপাদনে খরচ পড়ে ২১১ টাকা ৯ পয়সা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১২৭ কোটি ৩ লাখ ৮১ হাজার টাকা খরচের বিপরীতে আয় হয় ৪০ কোটি ৬৫ লাখ ৭২ হাজার টাকা এবং প্রতি কেজি চিনি উৎপাদনে খরচ পড়ে ১৯৩ টাকা ৫৪ পয়সা।
মোবারকগঞ্জ চিনিকলের শ্রমিকরা বলছেন, প্রতিষ্ঠাকালীন যন্ত্রাংশ দিয়ে এখনো মিলের উৎপাদন কাজ চলমান। একটি যন্ত্র ২০ বছরের মতো ভালোভাবে কাজ করতে পারে। এই সময়ের বেশি হলে প্রতি বছরই মেরামত খরচ বাড়ে। ফলে এই যন্ত্র আধুনিকীকরণ না হলে লভ্যাংশ আশার সম্ভাবনা একেবারেই কম। মোবারকগঞ্জ চিনিকল শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ও শ্রমিক ফেডারেশনের আইন ও দরকষাকষি সম্পাদক গোলাম রসুল বলেন, কৃষিতে বিপ্লব ঘটলেও আখের উন্নত জাত না পাওয়ায় উৎপাদন বাড়েনি। বড় পরিসরে আমাদের ভেতরে কিছু দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা লক্ষ করা যায়। এগুলো দ‚র করতে হবে। মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাকিবুর রহমান খান বলেন, উৎপাদন বাড়াতে চাষিদের নিয়মিত সার, কীটনাশক সরবরাহ করা হচ্ছে। সর্বশেষ মাড়াই মৌসুমে কৃষকদের সব পাওনা সময়মতো পরিশোধ করা হয়েছে। আখের জাত উন্নয়নের কাজ চলছে। তবে চিনিকলের যন্ত্রাংশ নিয়ে বা আধুনিকীকরণের বিষয়ে কিছু বলতে রাজি হননি তিনি।