সেদিন বিভীষিকাময় পরিস্থিতির অবসান ঘটেছিলো
দর্শনা অফিস: আজ ৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর ভোরের ঘন কুয়াশা ভেদ করে পূর্ব আকাশে সূর্য উঁকি দেয়নি তখনো। পাখিরা গেয়ে ওঠেনি প্রভাতের গান। ঠিক তখনি শুরু হলো পাকহানাদার বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে তুমুল লড়াই। অবিরাম স্ট্যান গান, মেশিন গান, রাইফেলের গোলা বর্ষণ, আর সেলের বিকট শব্দে প্রকম্পিত হয়ে উঠেছিলো গোটা এলাকা। বাতাসে বারুদের গন্ধ, নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে দ্বিক-বি-দ্বিক হারা আবাল, বৃদ্ধ, বনিতা ভীত সন্ত্রস্থ। কেপে কেপে উঠছিলো হৃদপি-টা। প্রতি মুহূর্তে উকি দিচ্ছিলো মৃত্যু। ঘড়ির কাটা আনুমানিক যখন ১১টা, তখন খানেকটা হঠাৎ করেই থেমে গেলো গোলাগুলির শব্দ। তবুও যেন কোথাও কোনো মানুষের সাড়া নেই। পিনপতন নিস্তব্ধতা। শুধু মাঝে মাঝে ভেসে আসছিলো পাকহানাদার বাহিনীর কর্কশ কণ্ঠের আওয়াজ। মুক্তি কই হাই, মুক্তি কই হাই? তার কিছুক্ষণ পর মুক্তি বাহিনীর পক্ষ থেকে খবর দেয়া হয়েছিলো সীমান্তবর্তী গ্রামের যে যেখানে আছে দ্রুত নিরাপদ স্থনে চলে যাওয়ার জন্য। এক মুহূর্ত দেরি না করে সব কিছু ফেলে রেখে সন্তান-সন্ততি বুকে আকড়ে ধরে ছুটেছিলো মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে। সীমান্তবর্তী গ্রামগুলো জনমানব শূন্যে পরিণত হয়েছিলো। পরে আবার শুরু হয়েছিলো মুক্তি বাহিনীর গেরিলা আক্রমণ। পাক সদস্যরাও করেছিলো মোকাবেলা। চুয়াডাঙ্গা সীমান্ত এলাকার দামুড়হুদার কামারপাড়া, সুলতানপুর, মুন্সিপুর, জিরাট ও আকন্দবাড়িয়া দিয়ে দ্বিমুখি আক্রমণ চালায় মুক্তি বাহিনী। ঢুকে পরেছিলো দর্শনা সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে। তখন পিছু হটতে থাকে পাক হানাদার বাহিনী ও তার দোসররা। মুক্তি বাহিনীর প্রচ- লড়াইয়ের মুখে দর্শনা ও তার আশপাশ থেকে পালাতে বাধ্য হয়েছিলো পাকবাহিনী। নিহত হয়েছিলো বেশ কয়েকজন পাক বাহিনীর সদস্যকে। ৪ ডিসেম্বর শত্রু মুক্ত হয় দর্শনা। ভয়াবহ আতংকে রাত কাটিয়ে দর্শনা ও আশপাশের মানুষ গেয়ে ওঠে বিজয়ের গান। বিভীষিকাময় পরিস্থিতির ঘটে অবসান। বীর মুক্তিযোদ্ধারা সেই দিন দর্শনায় পতপত করে উড়িয়ে ছিলো সবুজের বুকে লাল সূর্য খচিত বিজয়ের পতাকা। আমরা পেয়েছিলাম স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। বিশ্ব মানচিত্রে লেখা হয়েছে বাংলাদেশের নাম। আজ সেই ইতিহাসের ৪ ডিসেম্বর দর্শনা শত্রু মুক্ত দিবস। এ দিবসটি যথাযথ মর্যাদার সাথে পালনের লক্ষ্যে মুক্তিযোদ্ধা সংগঠনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক সরকারি-বেসরকারি ও পেশাজীবী সংগঠন নানামুখি কর্মসূচি পালন করেছে।
জীবননগর ব্যুরো জানিয়েছে, ১৯৭১ সালের এই দিনে ভারতীয় সীমান্ত ঘেষা চুয়াডাঙ্গা জেলার জীবননগর উপজেলা হানাদার মুক্ত হয়। এ দিন মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় মিত্র বাহিনীর তুমুল প্রতিরোধের মুখে পাকহানাদার বাহিনী এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর জীবননগর ছেড়ে ঝিনাইদহ্ অভিমুখে পালিয়ে যায়। জীবননগর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার মো. নিজামউদ্দীন জানান, ১৯৭১ সালের ২৬ নভেম্বর জীবননগরে পাকহানাদার বাহিনীর পতন ঘটলেও চূড়ান্ত বিজয় আসে ৪ ডিসেম্বর। এদিন প্রত্যূষে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর কমান্ডার মেজর দত্ত ও ৮নং সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন মোস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র বাহিনী যৌথভাবে জীবননগর উপজেলার ধোপাখালী সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করে জীবননগর, দত্তনগর, হাসাদহ ও সন্তোষপুরে পাকবাহিনীর ওপর অতর্কিতভাবে ঝাপিয়ে পড়ে। শুরু হয় রক্তক্ষয়ী প্রচ- সম্মুখযুদ্ধের। এ যুদ্ধে পাকহানাদার বাহিনীর ২৯ বেলুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা যৌথ বাহিনীর কাছে পরাজিত হয়ে পার্শ্ববর্তী জেলা ঝিনাইদহের দিকে পালিয়ে যায়। এ সময় থানায় ফেলে যাওয়া পাকবাহিনীর ক্যাপ্টেন নারী ধর্ষণকারী ও অমানুষিক নির্যাতনকারী হিসেবে চিহ্নিত মুনছুর আলীর ব্যবহৃত জিপ গাড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা আগুন ধরিয়ে দেয় এবং থানার মালখানা থেকে উদ্ধার করে পাশবিক নির্যাতনের পর সদ্য হত্যা করা ৭-৮ জনের অজ্ঞাত পরিচয় যুবতীর লাশ। এ দিন স্বতঃস্ফূর্ত মুুক্তিপাগল মুক্তিযোদ্ধারা জীবননগরের মাটিতে প্রথম উত্তোলন করে স্বাধীন বাংলার পতাকা। শুরু হয় প্রশাসনিক কর্মকা-। মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রসুলকে প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও মজিবর রহমানকে থানা ইনচার্জ করে বে-সামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা চালু করা হয়। সে দিনের সেই ৪ ডিসেম্বর জীবননগর মুক্ত দিবস হিসেবে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ আজও এ দিনটি পালন করে আসছে।
পূর্ববর্তী পোস্ট
এছাড়া, আরও পড়ুনঃ