জীবননগরের বাঁকায় সার কান্ডে বিএনপি ও যুবদলের ৫ নেতা বহিষ্কার

অভিযোগ পাল্টা অফিযোগে লঙ্কাকান্ড : সাংবাদিক সম্মেলনে বহিস্কারাদেশ প্রত্যাহার দাবি

জীবননগর ব্যুরো: জীবননগর উপজেলার বাঁকা ইউনিয়নে কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণের জন্য গোডাউনে রাখা সরকারি প্রকল্পের ১২২ বস্তা জৈব সার পাচারের ঘটনায় বিএনপির ৫ নেতাকর্মীকে দল থেকে বহিস্কার করা হয়েছে। গতকাল বুধবার উপজেলা বিএনপি এক প্রেসবিজ্ঞপ্তিতে বিষয়টি সাংবাদিকদের নিশ্চিত করা হয়। তবে পরবর্তীতে আবুল কাশেমের বহিস্কারাদেশ প্রত্যাহার করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারে কোন প্রেসবিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়নি। দল থেকে বহিস্কার ৫ নেতা হচ্ছেন- বাঁকা ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আব্দুল খালেক, সাধারণ সম্পাদক আবুল বাশার, সহ-সভাপতি খাদেমুল ইসলাম খোকন, সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও জেলা বিএনপির সদস্য আবুল কাশেম এবং বাঁকা ইউনিয়ন যুবদলের আহ্বায়ক রাজা মালিথা। এর মধ্যে জৈব সার পাচার বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগ ও গণমাধ্যমে সমালোচনা করে বক্তব্য দেয়ার অপরাধে সভাপতি আব্দুল খালেক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম ও যুবদল আহ্বায়ক রাজা মালিথাকে বহিস্কার করা হয়।
এদিকে উপজেলা বিএনপির এমন কর্মকান্ডের প্রতিবাদে পাল্টা সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন বহিস্কৃত বাঁকা ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আব্দুল খালেক ও যুবদল আহ্বায়ক রাজা মালিথা। রাতে সাংবাদিক সম্মেলনে তারা উপজেলা বিএনপির এমন সিদ্ধান্তকে হঠকারিতা আখ্যা দিয়ে অবিলম্বে তাদের বহিস্কারাদেশ প্রত্যাহারের দাবি করেছেন। অপরদিকে দল থেকে বহিস্কৃত অভিযুক্ত সহ-সভাপতি খাদেমুল ইসলাম খোকন তার ফেসবুক পেজে এ নিয়ে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। স্ট্যাটাসে তিনি এ ঘটনার জন্য ক্ষমা প্রার্থনাসহ ঘটনার সাথে উপজেলা বিএনপির দুইজন শীর্ষ নেতা জড়িত আছেন বলে দাবি করে তাদের বিরুদ্ধেও সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি করেছেন। ফলে সার নিয়ে বিএনপিতে এখন অভিযোগ পাল্টা অভিযোগের লঙ্কাকান্ড শুরু হয়েছে।
খবরে প্রকাশ, বাঁকা ইউনিয়নে কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণের জন্য ৬২২ বস্তা জৈব সার বাঁকা ইউনিয়ন পরিষদের সেডে রাখা হয়। বাঁকা ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবুল বাশার ও সহ-সভাপতি খাদেমুল ইসলাম খোকন অনধিকার ভাবে নিয়ে রাখে বলে অভিযোগ। সরবরাহকৃত সার নি¤œমানের বলে অভিযোগ ওঠে। মঙ্গলবার রাতে বিএনপির ওই দুই নেতা এ সারের মধ্য থেকে ১২২ বস্তা সার পাওয়ার ট্রিলারযোগে অন্যত্র পাচার কালে বাঁকা ইউনিয়ন জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীসহ বিএনপির প্রতিপক্ষ গ্রুপ আটক করে।
এ ব্যাপারে বাঁকা ইউনিয়ন পরিষদের সচিব আশাদুর রহমান বলেছেন, বিগত ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল কাদের প্রধানের আমলে বাঁকা ইউনিয়নের কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণের জন্য এডিপি হতে ২ লক্ষ টাকা করে ৪ লক্ষ টাকার দুটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। পরবর্তীতে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ও ইউপি চেয়ারম্যান অপসারিত হলে প্রকল্পটি থেমে যায়। বর্তমান প্রশাসক উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা জুয়েল শেখ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে পিআইসি গঠন করেছেন। এ অবস্থার মধ্যে বিএনপি নেতা আবুল বাশার এ সার ইউনিয়ন পরিষদে নিয়ে আসে। ইউপি সচিব জানান, প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট না হয়েও তিনি কী-ভাবে এ সার নিয়ে আসলেন তা আমাদের জানা নেই।
বাঁকা ইউপি প্রশাসক জুয়েল শেখ জানান, এ জৈব সারের সাথে ইউনিয়ন পরিষদের কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। অফিসিয়ালিভাবে সার নেয়াও হয়নি। তারপরও যেহেতু ঘটনা ঘটেছে আমি ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিষয়টি খতিয়ে দেখছি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জানান, বিএনপি নেতা বাশারসহ সংশ্লিষ্টরা এ জৈব সার ওই প্রকল্পের মাধ্যমে জোরপূর্বক বিতরণের জন্য ইউনিয়ন পরিষদের সেডে এনে মজুদ করেন। সার বিতরণের পর তিনি প্রকল্পের বরাদ্ধকৃত ৪ লক্ষ টাকা বিল করে উত্তোলন করতেন; কিন্তু জনতার প্রতিরোধের মূখে তার সে পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।
এ ঘটনা উপজেলা জুড়ে ব্যাপক সমালোচিত হয়ে দাঁড়ালে উপজেলা বিএনপির পক্ষ হতে গতকাল দুপুরে প্রেরিত উপজেলা বিএনপির সভাপতি আনোয়ার হোসেন খান খোকন ও সাধারণ সম্পাদক মো. শাহজাহান যৌথ স্বাক্ষরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, আপনারা নিশ্চয় অবগত আছেন, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি দেশ ও গণমানুষের জন্য রাজনীতি করে। বিএনপি দীর্ঘ ১৭ বছর ফ্যাসিস্ট আওয়ামীলীগ সরকারের দমন-পীড়ন ও হামলা-মামলার শিকার হয়। অবশেষে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে সেই দানবী সরকার পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। বিএনপি একমাত্র আওয়ামী লীগ ও তার দোসর রাজনৈতিক দল ব্যতিত দেশের সকল রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে দেশকে এগিয়ে নিতে রাজনীতি করতে চায়। কিন্তু অতি সম্প্রতি সারাদেশের মত চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলায়ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ একটি দল বিএনপি বিরোধী রাজনীতি শুরু করেছেন। তারা বিএনপির বিরুদ্ধে মিথ্যা বানোয়াট মনগড়া কাহিনী সৃষ্টি করে অত্যন্ত কৌশলে সুযোগ নিচ্ছে এবং বিএনপি ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে রাজনৈতিক হীনস্বার্থ চরিতার্থ করিতেছে। তাদের এই হীন রাজনীতি দিন-দিন এলাকার শান্ত রাজনীতির পরিবেশ অশান্ত করে তুলছে। আমরা অতিসম্প্রতি লক্ষ্য করছি, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিভিন্ন স্থানে সামাজিক ও রাজনৈতিক ছোটখাটো ঘটনাকে পুঁজি করে ঘটনার সাথে অতিরঞ্জিত ঘটনা যোগ করে রাজনৈতিক হীনস্বার্থ চরিতার্থ করতে বিএনপির বিরুদ্ধে অপপ্রচারে লিপ্ত হয়।
সম্প্রতি বাঁকা ইউনিয়ন পরিষদে কৃষকদের জন্যে ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে জৈব সার দেয়ার জন্য একটি প্রকল্প তৈরি করা হয়। যা কোন রাসায়নিক কিংবা সরকারি বরাদ্দকৃত সার না। আব্দুল কাদের প্রধান বাঁকা ইউনিয়ন পরিষদের দায়িত্বে থাকাকালীন পিআইসির মাধ্যমে এগ্রো ডায়মন্ড কোম্পানীর কাছ থেকে ৬১২ বস্তা জৈব সার ক্রয় করে। পরবর্তীতে এগ্রো ডায়মন্ড কোম্পানী ক্রয়কৃত সার ইউনিয়ন পরিষদের সেডে রেখে আসে। এই সার নি¤œমানের হওয়ায় কোম্পানীকে ফেরত নেয়ার জন্য বলা হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত মঙ্গলবার বিকেলে এগ্রো ডায়মন্ড কোম্পানী ১২২ বস্তা সার পাওয়ারটিলারে করে ফেরত নিয়ে যাচ্ছিলো। এ সময় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও স্থানীয় কয়েকজন সারের গাড়ি আটকিয়ে বি-শৃঙ্খলা পরিবেশ তৈরি করে। এ ঘটনায় বিএনপিকে জড়িয়ে নানা অপপ্রচার চালানো হচ্ছে, প্রকৃত পক্ষে বিএনপির সাথে এ কোন সম্পৃক্ততা নাই। এদিকে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাঁকা ইউনিয়ন বিএনপির দুটি গ্রুপের মধ্যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এরই পরিপেক্ষিতে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে দুই গ্রুপ হতে ৫ জনকে বহিস্কারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বহিস্কৃতরা হচ্ছেন-বাঁকা ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আব্দুল খালেক, সাধারণ সম্পাদক আবুল বাশার, সহ-সভাপতি খাদেমুল ইসলাম খোকন, উপজেলা বিএনপির সদস্য আবুল কাশেম ও বাঁকা ইউনিয়ন যুবদলের আহ্বায়ক রাজা মালিথা। প্রেসবিজ্ঞপ্তিতে তাদেরকে অভিযুক্ত করা হয় এবং দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে দল থেকে বহিস্কার করা হয়।
এদিকে গতকাল রাতে বাঁকায় দলীয় কার্যালয়ে বহিস্কৃত সভাপতি আব্দুল খালেক ও যুবদল আহ্বায়ক রাজা মালিথা এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন। সংবাদ সম্মেলনে রাজা মালিথা লিখিত বক্তব্যে বলেন, গত মঙ্গলবার মিনাজপুর ও মোক্তারপুর ১ ও ২ ওয়ার্ড যুবদলের কর্মী সভা ছিলো। আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। এমতাবস্থায় মুঠোফোনে জানতে পারি বাঁকা ইউনিয় বিএনপি সাধারণ সম্পাদক আবুল বাসার ও সহ-সভাপতি খালেমুল ইসলাম খোকন যোগসাজসে ১টি পাওয়ার টিলার ভর্তি ১২২ বস্তা জৈব সার রাত আনুমানিক ৮ ঘটিকার সময় বাঁকা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে পাচার করছেন। জনগণ টের পেলে পিছু নেয় এবং ধাওয়া করে লক্ষ¥ীপুর ব্রীজের ওপর থেকে পাওয়ার ট্রিলারটি আটক করে ইউনিয়ন পরিষদে আনে। এসময় ড্রাইভার ও চৌকিদারের জবানবন্দী রেকর্ড করে। আবুল বাসার ও খাদেমুল ইসলাম খোকনের পুরোপুরি সম্পৃক্ততা প্রমাণ পেলে আমরা তা দোষি ব্যক্তির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানাই এবং বিএনপির নাম ভাঙ্গিয়ে ব্যক্তি স্বার্থ হাসিল করতে চাইলে এর দায়ভার বিএনপি নেবে না মর্মে সাংবাদিকগণ জানতে চাইলে আমরা মনের ভাব প্রকাশ করি। যা আমরা এই ঘটনা সাথে কোন ভাবে সম্পৃক্ততা নয়, চোরের বিপক্ষে কথা বলায় আমাদের বহিস্কার করা হয়েছে। আমরা ইতোমধ্যে সোস্যাল মিড়িয়ায় জানতে পারি আমাদেরকে দল হতে বহিস্কার করা হয়েছে। যা খুবই দুঃখজনক এবং আমাদেরকে হতাশ করেছে। আমরা অবিলম্বে আমাদের বিরুদ্ধে অন্যায় ভাবে দেয়া বহিস্কারাদেশ প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি।
অপরদিকে বহিস্কৃত সহ-সভাপতি খাদেমুল ইসলাম খোকন তার ফেসবুক পেজে এ নিয়ে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। স্ট্যাটাসে তিনি বলেন, আপনারা সবাই ফেসবুকের মাধ্যমে গতকাল রাতের সার সংক্রান্ত অনাকাঙ্খিত ঘটনা সম্পর্কে অবগত আছেন। এই ঘটনায় ইতোমধ্যে আমাকে বহিস্কার করা হয়েছে। এই ঘটনায় উপজেলা বিএনপির দুই বড় পদধারী নেতাও জড়িত ছিলো। তারা দুইজনই সাবেক ইউনিয়ন চেয়ারম্যান। আমি চাই তাদেরকেও সাংগঠনিক শাস্তির আওতায় আনা হোক। এ ঘটনায় যা হয়েছে, যা ঘটেছে এর জন্য আমি নিজে ভীষণ লজ্জিত। এই ব্যাপারে আমার কোন ব্যাখ্যা নেই। আমি সকলের কাজে ক্ষমা চাই এবং আজ থেকে আমি রাজনীতি ছেড়ে দিলাম। তবে বহিস্কৃত অপর নেতা আবুল বাশারের কোন মতামত পাওয়া যায়নি। এদিকে জীবননগর থানা পুলিশ আটককৃত ৬২২ বস্তা জৈব সার জব্দ করে থানাতে নিয়েছে বলে জানা গেছে।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More