চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার আড়ালে টেস্ট বাণিজ্য
ডা. আব্দুর রহমানকে দেখাতে গিয়ে প্রতারণার শিকার রোগী : নীরব কর্তৃপক্ষ
স্টাফ রিপোর্টার: বাংলাদেশ ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা শিক্ষা আইন-২০২০ এর একটি অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, একজন ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক কোন অবস্থাতেই অন্য কোন চিকিৎসা পদ্ধতির ওষুধ রোগীকে সেবন বা গ্রহণ করবার পরামর্শ দিতে পারবেন না। আইনে সাজার বিষয়েও উল্লেখ রয়েছে। অনুমোদনহীন ওষুধের প্রেসক্রিপশন দিলেও এক বছরের কারাদ- বা এক লাখ টাকা জরিমানা বা উভয়দ- হতে পারে। এই আইন তোয়াক্কা না করেই চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক হুমায়ুন কবির নিজের ইচ্ছামত এলোপ্যাথি রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এমনকি রোগীদের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করাচ্ছেন। বিষয়টি হুমায়ুন কবির নিজেই স্বীকার করেছেন। চিকিৎসক নেতারা বলছেন, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকরা এলোপ্যাথি চিকিৎসা পরামর্শ বা ওষুধ লিখতে পারবেন না৷ বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করারও পরামর্শ দিতে পারবেন না। তবে হাসপাতালে কর্তৃপক্ষ যেন নিরব দর্শক। তাদের চোখের সামনেই দীর্ঘদিন যাবত আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার আড়ালে এলোপ্যাথি চিকিৎসা দিয়ে আসছেন তা দেখেও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় না বলে অভিযোগ সচেতন মহলের।
জানা গেছে, গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে চুয়াডাঙ্গা দামুড়হুদার মদনা গ্রামের শফিকুল ইসলাম নামে এক রোগী ঘাড়ের সমস্যাজনিত কারণে সদর হাসপাতালের অর্থোপেডিক চিকিৎসক ডা. আব্দুর রহমানকে দেখাতে আসেন৷ হাসপাতালের নতুন ভবনের দ্বিতীয় তলায় হিমেল নামে এক যুবককে ডা. আব্দুর রহমানের কক্ষ কোনটা জিজ্ঞাসা করলে তিনি আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক হুমায়ুন কবিরের কক্ষ দেখিয়ে দেন। পরে শফিকুল ইসলাম আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক হুমায়ুন ঘাড়ের এক্স-রে, ইউরিক অ্যাসিডসহ মোট তিনটা পরীক্ষা করার পরামর্শ দেন। এরপরই হিমেলের সহযোগিতায় হাসপাতালের পাশেই বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গ্রীন লাইফ মেডিকেল সেন্টারে যান। সেখানে ১ হাজার ১০০ টাকা দিয়ে তিনটা টেস্ট সম্পন্ন করেন। এর মধ্যে শফিকুল ইসলাম জানতে পারেন তিনি প্রতারণার শিকার হয়েছেন। ডা. আব্দুর রহমানের পরিবর্তে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসককে দেখিয়েছেন। এরপরই গ্রীন লাইফ মেডিকেল সেন্টার থেকে ১ হাজার ১০০ টাকা ফিরিয়ে নেন এবং আবারো টিকিট কেটে ডা. আব্দুর রহমানকে দেখালে তিনি দুটি ওষুধ লিখে দেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হিমেল রোগী প্রতি কমিশনে গ্রীন লাইফ মেডিকেল সেন্টারের হয়ে কাজ করেন। হাসপাতাল থেকে বিভিন্নভাবে রোগী ভাগিয়ে গ্রীন লাইফে নিয়ে যায়। গতকালও ভুক্তভোগী রোগী শফিকুল ইসলামকে ভাগিয়ে গ্রীন লাইফ মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে যান। তবে হিমেল বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, আমি গ্রীন লাইফ মেডিকেল সেন্টারে রোগীদের রক্ত কালেকশন করি। গতকাল হাসপাতালে আমার ছোট বোনের বাচ্চাকে ডাক্তারের নিকট নিয়ে গিয়েছিলাম। এসময় আমার নিকট এক বয়স্ক লোক জিজ্ঞাসা করেন ডা. আব্দুর রহমানের কক্ষটা কোথায়। আমি তাকে কক্ষ দেখিয়ে দিই। আমি তাকে গ্রীন লাইফ মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে যায়নি।
গ্রীন লাইফ মেডিকেল সেন্টারে কর্মরত আরফিনা খাতুন দৈনিক মাথাভাঙ্গাকে বলেন, ঘটনার পর ওই রোগী এবং হিমেলকে মুখোমুখি করেছিলাম। হিমেলের দাবি, ওই রোগীকে ডা. আব্দুর রহমানের নিকট রেফার্ড করার জন্য আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকের নিকট পাঠানো হয়েছে। আর রোগীর দাবি, ডা. আব্দুর রহমান বলে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক হুমায়ুন কবিরের নিকট পাঠিয়েছে হিমেল।
তিনি আরও বলেন, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক ওই রোগীকে তিনটা পরীক্ষা দিয়েছিলেন। আমার এখান থেকে এক হাজার ১০০ টাকা দিয়ে পরীক্ষা করান ওই রোগী। পরে ওই সম্পন্ন টাকা ফেরত নিয়ে গেছেন তিনি।
এদিকে, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক হুমায়ুন কবির দীর্ঘ কয়েকবছর যাবত গ্রীন লাইফ মেডিকেল সেন্টারে ব্যক্তিগত চেম্বার বসিয়ে রোগী দেখে আসছেন বলে জানিয়েছে গ্রীন লাইফ কর্তৃপক্ষ। সেখানেও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার পাশাপাশি এলোপ্যাথি চিকিৎসা দিচ্ছেন বলেও জানা গেছে।
আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক হুমায়ুন কবির দৈনিক মাথাভাঙ্গাকে বলেন, ওই রোগীর ঘাড়ের সমস্যাজনিত কারণে আমার নিকট এসেছিলেন। তাকে তিনটা পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দেয়া হয়। এলোপ্যাথি চিকিৎসা দিতে পারবেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, সব ধরনের চিকিৎসা দিতে পারি আমরা। আমরাও এমবিবিএস চিকিৎসকদের মত পড়াশোনা করেছি। তিনি আরও বলেন, ওই রোগী ডা. আব্দুর রহমানের নিকট এসেছিলেন কিনা জানি না। তিনি আমার নিকট এসে কিছুই বলেননি। আমাকে জানালে আমি অবশ্যই ডা. আব্দুর রহমানের নিকট রেফার্ড করে দিতাম।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) চুয়াডাঙ্গা জেলার সভাপতি ডা. মার্টিন হিরক মার্টিন হীরক চৌধুরী দৈনিক মাথাভাঙ্গাকে বলেন, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক কোনভাবেই এলোপ্যাথি চিকিৎসা দেয়ার সুযোগ নেই। পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেয়া তো দূরের কথা। তারা শুধু আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় দিতে পারবেন।
চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. এএসএম ফাতেহ্ আকরাম দোলন বলেন, একজন আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা দিতে পারবেন না। কোনোপ্রকার পরীক্ষা-নিরীক্ষাও দিতে পারবেন না।