চুয়াডাঙ্গার আকন্দবাড়িয়ার একই পরিবারের ১৩ সদস্যের বিরুদ্ধে ৯৫টি মাদক মামলা
নানা কৌশলে চালিয়ে যাচ্ছে মাদকের কারবার
নজরুল ইসলাম: মাদক সেবন বা বিক্রি করা আইনত দ-নীয় অপরাধ। যা সবারই জানা। আর যারা মাদকের সাথে সংশ্লিষ্ট তারা দেশ ও জাতির ভয়ঙ্কর শত্রু। তারপরও থেমে নেই অনেকেই। এমনি একটি আলোচিত পরিবার রয়েছে চুয়াডাঙ্গার দর্শনা থানাধীন আকন্দবাড়িয়া গ্রামে। পরিবারের ২৫জন সদস্য কোনো না কোনোভাবে মাদকের সাথে জড়িত। আর এসব কারবার করতে গিয়ে ওই পরিবারের বিভিন্ন জনের নামে রয়েছে ৯৫টি মাদক মামলা। মাদককে নেশা আর পেশা হিসেবে বেচে নিয়ে এদের মধ্যে কেউ কেউ নানা কৌশলে এখনও চালিয়ে যাচ্ছে তাদের কারবার। আবার কেউ প্রশাসনের তৎপরতায় গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে বিভিন্ন জায়গায়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অভিযান অব্যাহত থাকলেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিভিন্ন কৌশলে ওই পরিবারের কোন কোন সদস্য চালিয়ে যাচ্ছে কারবার। তাই তো প্রতিদিনই কোনো না কোনোভাবে উর্দ্ধার হচ্ছে মাদক। গ্রেফতার হচ্ছে মাদককারবারি। পক্ষান্তরে একটি সুস্থ পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র আমাদের সকলেরই কাম্য। কারণ আজকের প্রজন্ম আগামীদিনের জাতির ভবিষ্যত।
দেশবিভাগের পর ভারত থেকে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে এসে আশ্রয় নেয় ইউছুপ মোল্লা। সেখান থেকে সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে ইউছুপ পরিবার পরিজন নিয়ে চলে আসেন চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার বেগমপুর ইউনিয়নের দর্শনা থানাধীন আকন্দবাড়িয়া গ্রামের ফার্মপাড়ায়। ইউছুপ মোল্লা আজ বেঁচে নেই। মৃত্যুর আগে ৫ মেয়ে আর ১ ছেলে রেখে গেছেন। কেউ অভাবে আবার কেউ স্বভাবে আশির দশকের দিকে ইউছুপের ছেলে-মেয়েরা মাদক কারবারের সাথে জড়িয়ে পড়েন। বর্তমানে ওই পরিবারের ১৩ জন সদস্যের নামে রয়েছে ৯৫টি মামলা। প্রতিটি মামলায় মাদক সংক্রান্ত।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইউছুপ মোল্লার ৫ মেয়ের মধ্যে আছে রহিমা. হামিদা, রাশিদা, হিবলি, ছোট বুড়ি ও একমাত্র ছেলে কাউছার। রহিমার আছে ৪ ছেলে কামরুল, রনি, জনি ও সজিব। ২ মেয়ে জোস্না ও আলপনা। হামিদার ২ ছেলে হামিদ ও মোল্লা মেয়ে শিপ্রা ও রুবিনা (মৃত)। রশিদার ২ ছেলে জুলু ও জেলার একমাত্র মেয়ে জুলিয়া (মৃত)। ছেলে জুলু ফেনসিডিল আনতে গিয়ে বিএসএফ’র গুলিতে নিহত আর সিজার হতে যেয়ে জুলিয়ার মৃত্যু হয়। ছোট বুড়ির এক ছেলে ও ২ মেয়ে। ইয়াছিন, তানজিলা ও
তারিনা। এছাড়াও আকলী, মুনিয়া, লালবানু এই পরিবারের সদস্য। পুলিশসূত্রে জানা গেছে, এদের মধ্যে রহিমার ৭টি, হামিদার ১০টি, রশিদার ২২টি, ছোটবুড়ির ১০টি, কাউছারের ১টি, কামরুলের ৯টি, রনির ৬টি, জনির ১২টি, হামিদার ১টি, জুলুর ২টি, জুলিয়ার ১৩টি, ইয়াছিন আলীর ১টি ও আকলীর নামে ৩টি মাদক মামলা রয়েছে। এছাড়াও পরিবার সংশ্লিষ্ট আব্দুল কাদেরের ছেলে শাজাহানের নামে ৪টি, ছানুর ছেলে ওয়াশিমের নামে ৭টি ও দুখুর ছেলে ইস্রাফিলের নামে ২টি মাদকের মামলা রয়েছে। মাথায় এতো মাদকের মামলা থাকা স্বত্বেও এদের মধ্যে কেউ কেউ এখনও বিভিন্ন কৌশলে ফেনসিডিল ও ইয়াবার কারবার চালিয়ে যাচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গ্রামের কয়েকজন জানিয়েছে, এ পরিবারের মাদককারবারিরদের মধ্যে ২জন মারা গেছে, কয়েকজন জেলে আছে। জেলে থাকলেও সেখান থেকে মাদককারবার নিয়ন্ত্রণ করে যাচ্ছে। এই একটি পরিবার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মাদকের কারবার করে আসছে দীর্ঘদিন থেকে। এরা প্রশাসন কিংবা কেস কাচারির ভয় পায় না। আবার অনেক ক্ষেত্রে এদের বিরুদ্ধে কেউ মুখখুললে তাদেরকে নানাভাবে হয়রানি করে থাকে। তাই ভয় এবং আত্ম-সম্মানের কারণে কেউ কিছু বলতে সাহস পায় না। কারণ এদের সাথে মাদকাশক্ত অনেক শ্রেণিপেশার মানুষ জড়িত আছে। সূত্র জানায়, বর্তমানে ফেনসিডিলর দাম আকাশ চুম্বি হওয়ায় এরা ইয়াবা বিক্রি করছে। ফেনসিডিলের চাইতে ইয়াবা ট্যাবলেট শরীরের বিভিন্ন স্পর্শকাতর জায়গায় লুকিয়ে রাখা যায়। যা সহজে খদ্দেরদের হাতে পৌঁছে দিতে পারে। নারী পুলিশ ছাড়া অভিযান চালোনা এবং গ্রেফতার করা পুরুষ পুলিশ সদস্যদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ এই পরিবারের নারী মাদককারবারিকে গ্রেফতার করতে গিয়ে প্রশাসনের অনেক সদস্যকে ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। তাই প্রশাসনের কাছে তথ্য থাকলেও সহসায় তাদের সাথে ঝামেলায় জড়াতে চায় না।
এদিকে সচেতনমহল মনে করে, মাদক ধ্বংস করে দেশ জাতি পরিবার সমাজ এমন কি ব্যক্তিকে। একটি পরিবারের একজন সদস্য মাদককারবারি কিংবা সেবনকারী হলে পুরো পরিবারজুড়ে বিরাজ করে অশান্তি। মাদকের টাকা জোগাড় করতে গিয়ে যেকোনো অন্যায়ের পথ বেছে নেয় এরা। মাদকের কারণে মানব উন্নয়ন আজ বিঘিœত। আর মানব উন্নয়ন ছাড়া দেশ ও জাতির উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই তো মাদককারবারিরা দেশ ও জাতির ভয়ঙ্কর শত্রু। এদের রুখতে না পারলে যুবসমাজ যেমন হয়ে পড়বে পঙ্গু; তেমনি মানুষ হারাবে কার্যক্ষম। সমাজে নেমে আসবে অবক্ষয়। জনৈক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জানালেন, মাদক সেবন মানুষের স্বাভাবিক শারীরিক ও মানসিক অবস্থার ওপর প্রভাব ফেলে। মাদকদ্রব্য সেবনে তন্দ্রাচ্ছন্নতা, মেজাজ পরিবর্তন, মানসিক, আচ্ছন্নতা রক্ত চাপের পরিবর্তন ঘটায়। মাদকদ্রব্য গ্রহণ করলে মানুষের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার উল্লেখযোগ্য নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটায়। দিন দিন মাদক গ্রহণের ফলে এর প্রতি আসক্তি বাড়ে যায়। মাদক সেবনের পরপরই ব্যক্তির মস্তিষ্কে ডোপামিন নামক নিওরোট্রান্সমিটার বৃদ্ধি পায়। দীর্ঘদিন ধরে মাদক সেবন করলে একজন মানুষ তার সকল কার্যক্ষম হারিয়ে ফেলে। প্রকৃতপক্ষে দেখা যায় মাদকাসক্ত ব্যক্তি আসলে একটা সময়ে আর আনন্দের জন্য নেশা করে না। এটা তার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। ফলে মাদকই হয়ে পড়ে মাদকাসক্ত ব্যক্তির একমাত্র চিন্তা চেতনা। এক সময় মাদকের ক্ষতিকর প্রভাবে ডেকে আনে তার মৃত্যু। এ কারবারের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমাজের বিত্তশালী ব্যক্তি থেকে শুরু করে নারী ও শিশু-কিশোররাও জড়িত। এটা সহজেই অনুমান করা যায় যে, মাদকাসক্তির কারণে যুব সমাজের নিজেদের জীবন শুধু বিপন্ন হয় না, এতে গোটা পরিবার এবং সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রতিদিনই জেলার কোথাও না কোথাও ধরা পড়ছে মাদকের চালান। বরাবরের মতই ধরাছোয়ার বাহিরে থেকে যাচ্ছে মূলহোতারা। যদিও পুলিশ, বিজিবি, র্যাব, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পক্ষ থেকে মাদকবিরোধী অভিযান অব্যাহত রয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে এতোকিছুর পরও মাদক আসছে কোথা থেকে? আর কারায় বা এই সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছে? মাদককারবারিরা এতোই শক্তিশালী? বর্তমান সরকার মাদকের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছে। যেকোনো মূল্যে মাদককে শূন্যের কোঠায় আনতে কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে পুলিশ-প্রশাসনকে। এছাড়া চুয়াডাঙ্গা পুলিশ সুপার জাহিদুল ইসলাম যোগদানের পর থেকেই মাদকের বিরুদ্ধে জিরোট্র্রলারেন্স নীতি অবলম্বন করেছেন। প্রত্যেক থানা-ফাঁড়ির অফিসারকে মাদককারবারিকে গ্রেফতার ও মাদকদ্রব্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে দিয়েছেন কঠোর নির্দেশনা। সেই মোতাবেক চুয়াডাঙ্গা জেলায় মাদকবিরোধী অভিযান চলমান থাকলেও প্রতিদিনই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়ছে মাদককারবারি, উদ্ধার হচ্ছে মাদক। আকন্দবাড়িয়াকে মাদকের অভারণ্য বলেই এখন সকলের কাছে পরিচিত। গুটি কয়েকজনের জন্যই গ্রামের যতো বদনাম। মৃত ইউছুপের পরিবারকে মাদকের রমরমা ব্যবসা বন্ধ করা সম্ভব হলে আকন্দবাড়িয়ায় মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে সচেতনমহল মনে করছে।
এ ব্যাপারে চুয়াডাঙ্গা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক শরিয়ত উল্লাহ বলেন, এ পরিবারের সদস্যরা ভয়ানক। তারপরও আমরা থেমে নেই। সুনির্দিষ্ট তথ্য পেলেই অভিযান চালিয়ে তাদেরকে গ্রেফতার করা হবে। ইয়াবা ট্যাবলেট আকারে ছোট হওয়ায় ওই পরিবারের নারীরা শরীরের বিভিন্ন জায়গায়; এমন কি চুলের খোপার মধ্যেও রেখে দেয়। মোবাইলে যোগাযোগ করে খদ্দের আসা মাত্র সরবরাহ করা সহজ হয়। দর্শনা থানার অফিসার ইনচার্জ ওসি মাহাব্বুর রহমান কাজল বলেন, মাদকের সাথে কোনো আপস নয়। মাদককারবারিরা জাতির শত্রু। তাই শত্রু দমন করতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। দর্শনা থানা পুলিশের অভিযান অব্যাহত থাকায় অনেক মাদককারবারি এলাকা ছেড়ে পালিয়েছে। আবার অনেকেই গ্রেফতার হয়ে জেলহাজতে আছে। দর্শনা থানা এলাকা মাদকমুক্ত করতে প্রয়োজন সকলের সহযোগিতা।