স্টাফ রিপোর্টার: আপিল নিষ্পত্তির আগেই ফাঁসি কার্যকর হওয়া ভাগ্যাহত আবদুল মোকিম ও গোলাম রসুলের পরিবার ক্ষতিপূরণ চায়। একই সাথে বিষয়টি তদন্তপূর্বক দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও চান তারা। তবে পরিবারের কেউ কেউ বলেন ‘ফাঁসি তো হয়েই গেছে এখন ওসব ঘাটাঘাটি করে নতুনভাবে কোনো সমস্যায় জড়াতে চাই না। অসহায় পরিবারের পক্ষে ওসব করতে যাওয়া মানেই আবার খরচখরচা। কিন্তু তাতে লাভ কী? হারানো মানুষ তো আর ফিরে পাবো না।
ফাঁসি কার্যকর হওয়া আবদুল মোকিম ও গোলাম রসুল ঝড়ু–র বাড়ি আলমডাঙ্গা উপজেলার দুর্লভপুর গ্রামে হলেও তাদের পরিবারের কেউই সে গ্রামে থাকেন না। ১৯৯৪ সালে হত্যাকা-ের ঘটনার পর গোলাম রসুল ঝড়–র পরিবার চলে যায় একই উপজেলার বেতবাড়িয়া গ্রামে। ঝড়–র তিন ছেলে। বড় ছেলে তারিকুল ইসলাম, মেজ ছেলে ওমর ফারুক ও ছোট ছেলে আরিফুল ইসলাম। তারা সবাই দিনমজুর। ঝড়–র স্ত্রী আনজিরা খাতুন জানান, ‘আমরা ভূমিহীন। আমাদের থাকার মতো ৪ কাঠা ভিটা জমি আছে। ছেলেরা খেটে খায়। মামলা চালাতে গিয়ে সব শেষ। আমাদের এখন কী হবে? আমরা সঠিক বিচার পাইনি। আমি তদন্ত সাপেক্ষে ক্ষতিপূরণ চাই। ঝড়–র পরিবারের কেউ কেউ বলেন, ‘ফাঁসি তো হয়েই গেছে এখন ওসব ঘাটাঘাটি করে নতুনভাবে কোনো সমস্যায় জড়াতে চাই না। অসহায় পরিবারের পক্ষে ওসব করতে যাওয়া মানেই আবার খরচখরচা। কিন্তু তাতে লাভ কী? হারানো মানুষ তো আর ফিরে পাবো না।’ ঝড়–র ছোট ভাই আজিম উদ্দিন জানান, ‘এলাকার একজনের মাধ্যমে আপিলের চেষ্টা করি। তিনি ৫০ হাজার টাকাও নিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো কাজ করেননি। পরে চুয়াডাঙ্গার অ্যাডভোকেট সামাদের মাধ্যমে আপিল করি। আপিল নিষ্পতির আগেই ফাঁসি কার্যকরের বিষয়টি হত্যাকা-ের শামিল। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক।’ এ ব্যাপারে চুয়াডাঙ্গা জজ কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী আবদুস সামাদ বলেন, ‘আপিলের বিষয়টি আমার স্পষ্ট মনে নেই। তবে অ্যাডভোকেট হেমায়েত হোসেন বেল্টুকে দিয়ে আপিলটি হয়তো করিয়েছিলাম। ওনার কাছে জানলেই স্পষ্ট হওয়া যাবে।’
এদিকে, হত্যাকা-ের ঘটনার পর মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার ভোলাডাঙ্গা গ্রামে তার শ্বশুরবাড়িতে চলে যায় আবদুল মোকিমের পরিবার। আবদুল মোকিমের দুই ছেলে-মেয়ে। বড় ছেলে মোখলেছুর রহমান দিনমজুর। মেয়ে মোমেনা খাতুনের বিয়ে হয়ে গেছে। স্ত্রী সারজিনা বেগম খুব অসহায়ত্বের মধ্যে দিন পার করছেন। মোকিমের বড় ছেলে মোখলেছুর রহমান জানান, ‘আলমডাঙ্গার দুর্লভপুর গ্রামে আমার বাবার ৪ কাঠা বসতভিটা ছিলো। সেটাও বিক্রি করে মামলা চালিয়েছিলাম। আর টাকা পয়সা যা ছিলো সবই মামলায় খরচ হয়ে গেছে। ওই ঘটনার পর আমার নানাবাড়ি মেহেরপুর গাংনী উপজেলার ভোলাডাঙ্গা গ্রামে আমরা চলে আসি। এখানে মামারা ২ কাঠা জমি দিয়েছেন থাকতে। আমি দিনমজুর। যেদিন কাজে যাই সেদিন চুলা জ্বলে, না গেলে উপস থাকতে হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘ফাঁসি কার্যকরের তিনদিন আগে যশোর কারাগার থেকে আমাদের বাড়িতে চিঠি পাঠানো হয়। আমার বাবা অসুস্থ তাই পরিবারের সাথে দেখা করতে চান বলে চিঠিতে বলা হয়। আমরা যেদিন যশোর কারাগারে যাই সেদিনই ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ফাঁসি কার্যকরের আগে একটিবারও আমার বাবার সাথে দেখা করতে দেয়নি কারা কর্তৃপক্ষ। ফাঁসির পর লাশ নিয়ে বাড়ি যেতে বলে জেলার। বিষয়টি কাউকে না বলতেও হুমকি দেয়া হয়। আমরা খুব গোপনে লাশ বাড়ি নিয়ে এসে দাফন করি।’
মোকিমের স্ত্রী সারজিনা বেগম জানান, ‘আমরা খুব অসহায় মানুষ। আপিল নিষ্পত্তির আগে আমার স্বামীকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। এটা খুব অন্যায় হয়েছে। এতোদিন ভয়ে আমরা কিছু বলতে পারিনি। আমরা এর ক্ষতিপূরণ দাবি করছি।’
মামলার বাদী মুক্তিযোদ্ধা অহিম উদ্দীন জানান, ‘আমার ভাই মুক্তিযোদ্ধা মনোয়ার হোসেন একজন ভালো মানুষ ছিলেন। তখন তিনি মেম্বারও ছিলেন। মূলত আলমডাঙ্গার কুমারী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তাকে হত্যা করা হয়। সে সময় নূর ইসলাম নামে একজন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীকে সমর্থন করাই ছিলো আমার ভাইয়ের অপরাধ। হত্যাকা-ের পর আমি বাদী হয়ে আলমডাঙ্গা থানায় ২১ জনকে আসামি করে মামলা করি। অপরাধীরা সবাই নিষিদ্ধ চরমপন্থী সংগঠন পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলো। আমরা আদালতে সাক্ষ্য দিতে যেতেও তখন ভয় পেয়েছি।’ তিনি আরও জানান, ‘মোকিম ও ঝড়– বাদেও মামলায় আরও অনেকে আসামি ছিলো। মোকিম ও ঝড়–র ফাঁসি কার্যকরে আমরা খুশি হয়েছি। কিন্তু ওই মামলার বাকি আসামিরা খালাস পাওয়ায় আমরা কষ্ট পেয়েছি।’
প্রসঙ্গত, ১৯৯৪ সালের ২৮ জুন আলমডাঙ্গা উপজেলার দুর্লভপুর গ্রামে তৎকালীন ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য মুক্তিযোদ্ধা মনোয়ার হোসেনকে খুন করে নিষিদ্ধ চরমপন্থী সংগঠন পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরা। একযুগ পর ২০০৮ সালের ১৭ এপ্রিল তিনজনের মৃত্যুদ-াদেশ, দুজনকে যাবজ্জীবন ও অপর আসামিদের খালাস দেন চুয়াডাঙ্গার অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালত-২। রায়ে ঝড়– ও মোকিমসহ তিনজনকে ফাঁসি ও দুজনকে যাবজ্জীবন কারাদ-াদেশ দেয়া হয়। হাইকোর্ট ঝড়– ও মোকিমের ফাঁসি বহাল রেখে বাকি সবাইকে খালাস দেন। পরে মোকিম ও ঝড়– সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল দায়ের করেন। আপিল নিষ্পত্তির আগেই ২০১৭ সালে মোকিম ও ঝড়–র ফাঁসি কার্যকর করে যশোর কারা কর্তৃপক্ষ। সম্প্রতি আপিলটি শুনানির জন্য আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় ওঠে। তারপর শুরু হয় দেশজুড়ে তোলপাড়।
পূর্ববর্তী পোস্ট
এছাড়া, আরও পড়ুনঃ