পদ্মার চর থেকে যুবকের ৯ টুকরো মরদেহ উদ্ধার : খুনের নেপথ্যে কুষ্টিয়ার বহিষ্কৃত ছাত্রলীগ নেতা ও কিশোর গ্যাং
কুষ্টিয়া প্রতিনিধি: কুষ্টিয়ায় পদ্মা নদীর দুর্গম চর থেকে মিলন হোসেন (২৮) নামের এক যুবকের খ-িত লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। লাশের ৯টি খ- পৃথক ৬ জায়গায় পুঁতে রাখা হয়েছিল। গতকাল শনিবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে সদর উপজেলার হাটশ হরিপুর ইউনিয়নের কান্তিনগর বোয়ালদহ সংলগ্ন পদ্মার চর থেকে লাশের টুকরোগুলো উদ্ধার করা হয়। মিলন হোসেন কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার পূর্ব বাহির মাদি এলাকার মাওলা বকসের ছেলে। তিনি পড়ালেখার পাশাপাশি আউট সোর্সিংয়ের কাজ করতেন। গত ১০ মাস আগে তিনি বিয়ে করেছেন। স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে কুষ্টিয়া শহরের হাউজিং এলাকায় ঈদগাহের পাশে ভাড়া বাড়িতে বসবাস করতেন। সেই সঙ্গে প্রযুক্তির ব্যবহার করে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে তিনি অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন করতেন বলে দাবি পুলিশের। এর আগে মিলনের ঘাতক সন্দেহে আটক ৫ যুবককে নিয়ে লাশের খোঁজে রাতভর পদ্মার চরে অভিযান চালায় পুলিশের একটি দল। অভিযানের নেতৃত্ব দেন কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পলাশ কান্তি নাথ। নিহতের পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, কী কারণে মিলনকে হত্যা করা হয়েছে। সে বিষয়ে তারা কিছুই জানে না। সকালে টিভির খবর মাধ্যমে জানতে পারি মিলনকে হত্যা করা হয়েছে। এ হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেন তারা।
কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের মর্গের সামনে মিলনের স্ত্রী মিমো খাতুন বলেন, সে আর তার স্বামী মিলন হাউজিংয়ের একটি বাসায় ভাড়া থাকতেন। বুধবার সকালে হাউজিং এলাকার সজল মিলনকে মোবাইলে কল করে ডাকে। তার সঙ্গে দেখা করে বাসায় এসে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আবার বের হয়ে যায়। তার পরে সে আর ফিরে আসেনি। ওইদিনই সে কুষ্টিয়া মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। পরেরদিন দুপুর পর্যন্ত আমার স্বামীর মোবাইল নম্বর খোলা ছিলো। কিন্তু তাকে পাওয়া যায়নি। পরে শনিবার সকালে তার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। মিমো বলেন, আমার স্বামীকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। হত্যার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেন মিমো।
পুলিশ জানায়, মিলন আউট সোর্সিংয়ের পাশাপাশি ইন্টারনেট ভিত্তিক বিভিন্ন ধরনের অনৈতিক কাজ করে টাকা উপার্জন করতেন। বিষয়টি জানার পর মিলনের বন্ধু ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত সহসভাপতি ও কিশোরগ্যংয়ের নেতা এসকে সজিব ও তার কয়েকজন সহযোগী গত বুধবার সকালে তাকে হাউজিংয়ের একটি ৬য়তলা বাড়িতে ডেকে নিয়ে যায়।
সেখানে মিলনের কাছে মোটা অঙ্কের টাকার দাবি করেন। মিলন টাকা দিতে অস্বীকার করলে মিলনকে বিভিন্নভাবে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করে। পরে লাশ গুম করার জন্য হেচকা ব্লেড দিয়ে মিলনের মহদেহের ৯ টুকরো করে নদীর চরে পুতে রাখে।
তাদের দাবি, চাঁদার দাবিতে কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত সাবেক সহ-সভাপতি এস কে সজিবের নেতৃত্ব এই হত্যাকা-। পুলিশ সজিবসহ তার সহকর্মী ফয়সাল, লিংকন, জনি এবং ইফতিকে গ্রেফতার করেছে।
কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস্) পলাশ কান্তি নাথ জানান, ৩১ জানুয়ারি বুধবার সকালে মিলন বাড়ি থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হয়। ওইদিন সন্ধ্যায় তার স্ত্রী মিমো খাতুন কুষ্টিয়া মডেল থানায় জিডি করেন। জিডির প্রেক্ষিতে তদন্ত শুরু করে পুলিশ।
মুঠোফোনের একটি কল লিস্টের সূত্র ধরে প্রথমে মিলনের এক বন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। তার স্বীকারোক্তিতে জানা যায় আরেকবন্ধু সজিবের নেতৃত্বে মিলনকে হত্যা করা হয়েছে। পরবর্তীতে গত শুক্রবার বিকেলে অভিযান চালিয়ে সজিবসহ আরও চারজনকে গ্রেফতার করা হয়।
জিজ্ঞাসাবাদে তারা মিলনকে হত্যার পর তার লাশ গুম করার উদ্দেশে হেসকা ব্লেড এবং সুপারি কাটা জাতি দিয়ে ৯ টুকরা করে নদীর চরে পুঁতে রাখার বিষয়টি স্বীকার করে। এরপর শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে তাদেরকে নিয়ে হাটশ হরিপুর ইউনিয়নের কান্তিনগর বোয়ালদহ পদ্মা নদীর চরে অভিযানে যায় পুলিশ। রাতভর অভিযান চালিয়ে নদীর চরের ছয় স্থান থেকে মিলনের খ-িত লাশ উদ্ধার করা হয়। এছাড়া হত্যাকা-ে ব্যবহৃত অস্ত্র বাঁধ বাজার এলাকা থেকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। তিনি আরও জানান, জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, টাকার দাবিতে মিলনকে হত্যা করা হয়েছে। জড়িতরা সবাই একে অপরের পরিচিত। মিলন বাড়ি থেকে অনলাইনে কাজ করতেন। নিখোঁজের দিন তাকে মুঠোফোনে ডেকে হাউজিং এলাকার একটি বাড়িতে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। ওইদিন রাতেই তাকে হত্যা করা হয়। এরপর লাশ গুম করার সুবিধার্থে হেসকা ব্লেড দিয়ে লাশ টুকরো টুকরো করে নদীর চরে পুতে রাখা হয়েছিলো। আর এই পুরো হত্যাকা-টির নেতৃত্ব দিয়েছে তারই বন্ধু সজিব। এর সঙ্গে অন্য কোনো ঘটনা আছে কিনা তা নিয়ে আরও তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এস কে সজিব কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি ছিলেন। কুষ্টিয়া ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের ভাঙচুর ও ইন্টার্ন চিকিৎসকদের মারধরের অভিযোগে তাকে বহিষ্কার করা হয়। সেই মামলায় জেল খেটেছে সে। এছাড়া তার নামে চাঁদাবাজিসহ ১২টি মামলা রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাউজিং এলাকার বাসিন্দারা জানিয়ছে, সজিবের নামে অনেক অভিযোগ রয়েছে। তার নেতৃত্বে একটি কিশোর গ্যাং পরিচালিত হয়। মিলন নামে যাকে হত্যা করা হয়েছে সেও তাদের মতোই ছিলো। তাদের কাজ ছিলো ছেলে-মেয়েদের ব্লাকমেইল করে চাঁদা দাবি করা।
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.